গাংনী প্রতিনিধি: চায়ের দোকানের মাচা থেকে অফিস পর্যন্ত স্বঘোষিত রাজনৈতিক বোদ্ধাদের নানা সমীকরণকে ভুল প্রমাণ করে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে পুনঃনির্বাচিত হয়েছেন মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন। একই সাথে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন আ.লীগের দুঃসময়ের পোড়খাওয়া আরেক নেতা মোখলেছুর রহমান মুকুল। গতকাল রোববার ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে কাউন্সিলরদের ভোটের মাধ্যমে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। গতকাল রোববার দুপুর দুইটার দিকে গাংনী পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ প্রাঙ্গণে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই দু’পক্ষের সংঘর্ষে উত্তপ্ত পরিবেশ বয়ে নিয়ে আসে। সম্মেলন প- ও পুনরায় সংঘর্ষের শঙ্কা নিয়ে সম্মেলন শুরু হয়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গাংনী উপজেলার আ.লীগের ১৮ বছর ধরে সভাপতির পদে থাকা মেহেরপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন। প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক। সম্মেলন উদ্বোধন করেন মেহেরপুর জেলা আ.লীগের সভাপতি ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। সম্মেলন উদ্বোধন করেন মেহেরপুর জেলা আ.লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গাংনী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এমএ খালেক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
বক্তৃতায় বিএম মোজাম্মেল হক আওয়ামী লীগের উন্নয়ন তুলে ধরে বিএনপি সরকারের আমলের কর্মকা- সম্পর্কে তুলো না করেন। বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা আজ বাস্তবায়ন হয়েছে। আর এর পেছনে রয়েছে সফল প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা আছে বলেই আওয়ামী লীগের অস্তিত্ব আছে। তার কারণেই দল ঐক্যবদ্ধ।
কোনো ব্যক্তির নয় শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ করার জন্য নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, আপনারা আজ কারা মাথায় লাঠি মারছেন? জামায়তা-বিএনপি না অন্য দলের কারও? অবশ্যই না। আপনারা একে অপরের মধ্যে যে বিরোধ আর বিশৃংখলা করছেন দিন শেষে তা নিজের ক্ষতিই করছেন। তাই কোনো ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে দলের লোকজনের ওপরে হামলা কইরেন না। কারও কথা শুনে আপনার আরেক ভাইকে আঘাত কইরেন না। এতে দল দুর্বল হবে। বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হবে দল। যদি আওয়ামী লীগ করেন তাহলে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আর নির্দেশনা মেনে করেন। ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগকে কেউ হারাতে পারবে না। আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ আ.লীগের শক্তিতে আবারও জয় আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
উদ্বোধনী বক্তৃতায় মেহেরপুর জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন জেলার উন্নয়নের সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরে বলেন, আজ শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আছে বলেই মেহেরপুর তথা সারা দেশের উন্নয়ন হয়েছে।
মুজিবনগর আমাদের গর্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের একটি সম্পদ আছে তা হচ্ছে মুজিবনগর। বঙ্গবন্ধুর নামে সারা দেশে আর কোন স্থানের নামকরণ নেই। কাজেই মুজিবনগর তথা মেহেরপুর জেলার মানুষ হবে সব কাজেই সারাদেশের মডেল। জাতির পিতার নাম আমাদের জেলায় আছে বলেই জননেত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নজর রয়েছে। আর এর ফল স্বরূপ মেহেরপুর জেলায় স্থলবন্দর, রেল লাইন, ভৈরব নদী পুনঃখননসহ বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে।
দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধতা কামনা করে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে হানাহানি মরামারি করে কোন লাভ নেই। এতে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। বৈধ, শ্রদ্ধাবোধ আর সহমর্মিতার মধ্যদিয়ে একসাথে চলার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
দুপুর তিনটার দিকে গাংনী হাইস্কুলে সম্মেলেন প্রথমপর্বে এ আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। ৫টার দিকে আলোচনাসভা সম্পন্ন হলে গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের ১৮ বছর আগে গঠিত কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ফরহাদ হোসেন এমপি। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় একই স্থানে কাউন্সিলরদের নিয়ে সম্মেলন অনুষ্ঠান হবে বলে ঘোষণ দেন তিনি।
এদিকে সাড়ে সাতটায় দ্বিতীয় পর্ব শুরু হলে উত্তেজনা শুরু হয় দু’পক্ষের মধ্যে। এক পর্যায়ে মঞ্চে মাইকের মাইক্রোফোন হাতে তুলে নেন বিএম মোজ্জামেল হক। কাউন্সিলর বাদে যারা উপস্থিত আছেন তাদেরকে বাইরে বের করে দেয়া হয়। এতে উত্তেজনা কিছুটা কমে আছে।
বিএম মোজাম্মেল হক এ সময় নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, গাংনী উপজেলার ৯টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা থেকে ৪০৪ জন কাউন্সিলর রয়েছেন। এতো মানুষের মতামত কিংবা ভোট নেয়া অসম্ভব। তাই শুধুমাত্র ইউনিয়ন ও পৌরসভার সভাপতি ও সম্পাদকদের ভোটের মাধ্যমে কাউন্সিল করার প্রস্তাব দেন তিনি। এ সময় হাত তুলে কাউন্সিলররা মতামতের পক্ষে রায় দেন। এতে ছোট হয়ে আসে কাউন্সিলের পরিধি। সে মত হাইস্কুলের দোতলায় প্রধান শিক্ষকের কক্ষে ১০ ইউনিটের ২০ জন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিয়ে নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়।
নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সভাপতি প্রার্থী হিসেবে মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকন, পৌর মেয়র আহম্মেদ আলী, নুর জাহান বেগম ও ডা. নাজমুল হুদা সাগর প্রার্থী হয়েছেন বলে ঘোষণা করেন বিএম মোজাম্মেল হক। এর মধ্য থেকে সভাপতি নির্বাচন বিষয়ে ১০ ইউনিটের ২০জন কাউন্সিলরের সকলেই মোহাম্মদ সাহিদুজ্জামান খোকনের পক্ষে কণ্ঠভোট প্রদান করেন। এর মধ্যদিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হন সাহিদুজ্জামান খোকন। এরপর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে প্রায় এক ডজন প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ। এ সময় কাউন্সিলররা কাকে নির্বাচিত করবেন তা নিয়ে একমত পোষণ করতে পারেননি। ফলে তাদের প্রত্যেকের হাতে শাদা কাগজের টুকরো তুলে দেন নেতৃবৃন্দ। কাকে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ভোট দিচ্ছেন তার নাম লিখে দেয়ার নির্দেশ দেন নেতারা। এ সময় শাদা কাগজের গোপনে নিজের মতামত প্রকাশ করেন ২০জন কাউন্সিলর। তাদের ভোটের মাধ্যমে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন মোখলেছুর রহমান মুকুল। ভোট প্রক্রিয়া শেষে রাত সাড়ে নয়টার দিকে ফলাফল ঘোষণা শুরু হয়। নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে নানা নির্দেশনা দিয়ে বক্তৃতা করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বিএম মোজাম্মেল হক। ফলাফল ঘোষণা করেন জেলা আ.লীগের সভাপতি ও জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
এদিকে ফলাল ঘোষণার আগেই নিশ্চিত পরাজয় মেনে নিয়ে মাঠ ত্যাগ করেন ডা. নাজমুল হক সাগর। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ ছাড়াও স্থানীয় নেতাকর্মীরা সাগরের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ডা. নামজুল হুদা সাগরকে বসন্তের কোকিল উল্লেখ করে নেতাকর্মীদের কয়েকজন বলেন, গাংনীর রাজনৈতিক ইতিহাসে কেউ কখনও তাকে দেখেনি। অথচ কাউন্সিলে সে সভাপতি প্রার্থী হয়ে গ-গোল সৃষ্টি করেছে। কাউন্সিলর শুরুর আগে সংঘর্ষের পেছনে ডা. নাজমুল হুদা সাগর ও তার লোকজনের ভূমিকা নিয়েও তীব্র সমালোচনা চলছে।
সম্মেলন শুরুর আগেই সংঘর্ষ: প্রত্যক্ষদর্শী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা জানান, মঞ্চে স্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত হয়ে আগত নেতাকর্মীদের অনুষ্ঠানস্থলে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিলেন। মঞ্চের সামনে আনুমানিক দেড় হাজার মানুষ চেয়ারে বসে ছিলেন। এ সময় ডা. নাজমুল হুদা সাগর, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ওয়াসিম সাজ্জাদ লিখন, উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোশাররফ হোসেন ও যুগ্ম সম্পাদক মজিরুল ইসলাম তাদের লোকজন নিয়ে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন। কর্মীদেরকে চেয়ারে বসার আহবান জানিয়ে নেতাদের মঞ্চের সামনে থাকা সংরক্ষিত চেয়ারে বসার জন্য নাম ঘোষণা করা হচ্ছিলো মাইকে। তারা মঞ্চের সামনে না বসে উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে মঞ্চের সামনে দিয়ে জায়গা দখলে নেয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে বেশ আগে থেকেই এমপি পক্ষের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে সেøাগান দিচ্ছিলো। তাদের সাথেই শুরু হয় সংঘর্ষ। সংর্ঘের এক পর্যায়ে মাইক ও মঞ্চ দখলে নিতে গেলে সংঘর্ষ আর তীব্রতা ধারণা করে। এ সময় সাগরের সমর্থক গাংনী থানাপাড়ার মহিবুল ইসলাম (৩৫) রক্তাত্ব জখম হয়। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা। সংঘর্ষে চেয়ার ও লাঠিপেটায় সাগরের লোকজন দাঁড়াতে পারেনি। ফলে তাদের জায়গা হয় মঞ্চের পশ্চিম পাশে। সংঘর্ষ কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিয়ন্ত্রণ করে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।
এদিকে এ সংঘর্ষের জের ধরে প্রথম পর্বের অনুষ্ঠান উভয়পক্ষের নেতাকর্মীদের সেøাগানে তীব্র উত্তেজনাময় পরিবেশ বিরাজ করে। যার প্রভাব পড়ে দ্বিতীয়পর্বে। তবে শেষ পর্যন্ত আর কোন সংঘর্ষ ছাড়াই সম্মেলন সম্পন্ন হয়। নিশ্চিত পরাজয় টের পেয়ে ফলাফল ঘোষণার আগেই মাঠ ত্যাগ করেন সাগর ও তার লোকজন।
এদিকে ফলাল ঘোষণার পরে সাহিদুজ্জামান খোকন ও মোখলেছুর রহমান মুকুলের গলায় ফুলের মালা দিয়ে বিজয় সেøাগান দেয় নেতাকর্মীরা।
মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকা: সাহিদুজ্জামান খোকন ও মোখলেছুর রহমান মুকুলের পিতা একাত্তরে স্বাধীনতা বিরোধী ছিলো এমন অভিযোগ তুলে তাদেরকে বাদ দিয়ে কাউন্সিলর করার চেষ্টায় বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন গাংনী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মোশাররফ হোসেনসহ তাদের পক্ষের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। এ দুই নেতার পিতা স্বাধীনতা বিরোধী ছিলেন না উল্লেখ করে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন নেতাকর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে। তাদের দুজনের বর্ণিল রাজনৈতিক সময় ও আওয়ামী লীগের জন্য ত্যাগের কথা আলোচনা হচ্ছিলো বিভিন্ন মহলে। যার ফল স্বরূপ কাউন্সিলের একদিন আগেই মুক্তিযোদ্ধাদের ইফতার মাহফিলে সাহিদুজ্জামান খোকনকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পক্ষ থেকে সভাপতি প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। সাহিদুজ্জামান খোকনকে সভাপতি পদে প্রস্তাবকারী ও সমর্থনকারীও হন বীর মুক্তিযোদ্ধা দু’জন। বিষয়টি এ কাউন্সিলের সবচেয়ে বড় চমক ছিল বলে উল্লেখ করেছেন অনেকে।