চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ও ঝিনাইদহের ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকদের সরকারের কাছে আর্থিক সহায়তা কামনা
স্টাফ রিপোর্টার: হঠাৎ দমকা ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও ঝিনাইদহসহ আশপাশের এলাকায়। গতকাল রোববার বেলা ৩টার দিকে শুরু হয় এ শিলাবৃষ্টি। ওই ঝড়োবৃষ্টিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে টিনের ঘরবাড়িসহ কাঁচা ও আধাপাকা স্থাপনার। বড় বড় শিলার দলায় ঢেকে আবৃত হয়ে গেছে মাটি। শিলায় ঢেকে যায় শহরের শহীদ হাসান চত্বর এলাকার সড়ক। দমকা হাওয়ায় সড়কের উপর ভেঙে পড়েছে গাছের ডালপালা। এতে ব্যাঘাত ঘটে স্বাভাবিক চলাচলেও। শিলাবৃষ্টির তা-বে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে মাঠের ফসলের। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমের মুকুল, ভুট্টা, পান, তামাক, ধানসহ বিভিন্ন উঠতি ফসল। তবে, তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপন করতে পারেনি কৃষি অফিস। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে এক ঘণ্টার ঝড়ে ক্ষয়ক্ষতি হয় পেঁয়াজ, ভুট্টা, গম, কলা, আমের মুকুল, লিচু, সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের। ফলে এই মৌসুমে প্রচুর লোকসানের আশঙ্কা কৃষকদের।
চুয়াডাঙ্গায় স্মরণকালের ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি হয়েছে। গতকাল রোববার বেলা ৩টা ১০ মিনিটে শুরু হয় এ শিলাবৃষ্টি। একটানা ১০ মিনিট শিলাবৃষ্টি স্থায়ী ছিলো। এরপর ৪টা পর্যন্ত ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতে থাকে। ঝড়ো-বৃষ্টিতে ল-ভ- হয়ে গেছে টিনের ঘরবাড়িসহ কাঁচা ও আধাপাকা স্থাপনা। এ সময় বড় বড় শিলায় ঢেকে গেছে মাটি। দমকা হাওয়ায় সড়কের ওপর ভেঙে পড়েছে গাছের ডালপালা। তবে এখনও থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে এ জেলায়।
চুয়াডাঙ্গায় আবহাওয়া ও কৃষি অধিদপ্তর বলছে, চুয়াডাঙ্গাবাসী পূর্বে এমন শিলাবৃষ্টি দেখেনি। কৃষকদের ফসলের এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো হয়নি। চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বাদুরতলা নামক স্থানে শিলাবৃষ্টিতে গাছে থাকা কিছু বাদুর মারা গেছে বলে এলাকার লোকজন জানান।
সরজমিন ঘুরে দেখা যায়, সদর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে শিলাবৃষ্টির কারণে ভূট্টা ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও কুল, তরমুজ, আম মুকুল, পান, তরমুজ, তামাক, টমেটোসহ সব ধরনের সবজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে ধানের বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। শিলাবৃষ্টিতে ভুট্টার সব গাছ ভেঙে এখন চাষিদের মাথায় হাত ওঠার উপক্রম হয়েছে। ভুট্টার গাছ ভেঙে মাটিতে শুয়ে পড়েছে। এখন এই ভুট্টারক্ষেত থেকে জ্বালানি ছাড়া আর কিছু পাওয়ার আশা নেই। এছাড়াও, যাদের টিনের চাল তাদের টিন ফুটোও হয়ে গেছে এই শিলাবৃষ্টিতে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকরা সরকারের কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা কামনা করছেন।
ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানায়, ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে সব ভুট্টা গাছ ভেঙ্গে শেষ হয়ে গেছে। তরমুজ ফুটো হয়ে গেছে। আমরা এখন কি খাবো। পরিবারকে নিয়ে পথে নামতে হবে বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। ঋণ নিয়ে বিঘা বিঘা জমিতে ভুট্টা আবাদ করেছিলাম। শিলাবৃষ্টি আর ঝড়ে ক্ষেতের সব ভুট্টা গাছ ভেঙে গেছে। জমিতে ভুট্টা চাষের আর কোন সুযোগ নেই। এখন ঋণের কিস্তি পরিশোধ করবো কিভাবে?
দামুড়হুদা উপজেলার নতিপোতা গ্রামের কৃষক মতিয়ার রহমান জানান, বিকালে হঠাত করি ঝড় শুরু হয়। পরে পানির সাথে শিল পড়ে। মাটে গিয়ি দেকি সব শেষ হয়ি গিয়িচে। ভুট্টু, কলাসহ সব চাষ মাটির সাতে মিশি গিয়িচে। এই বছর আমাদের খুব লচ হবে।
চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার বাসিন্দা আবুল কাশেম জানান, দুপুরে আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিলো। বিকেলে হঠাৎ মেঘের মৃদু গর্জনের সাথে শুরু হয় ঝড় ও শিলাবৃষ্টি। যা গত ৫০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। বাড়ির উঠান ও সড়কের ওপর শিলার স্তুপ জমে যায়। এমন শিলাবৃষ্টি এর আগে কখনও দেখা যায়নি। শুধুমাত্র চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকায় পাঁচ শতাধিক টিনের চাল ফুটো হয়েছে বলে একাধিকসূত্র নিশ্চিত করেছে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা কৃষি অফিসার তালহা জুবায়ের বলেন, শিলা বৃষ্টির পর আমি ফসলের মাঠ পরিদর্শন করছি। সদর উপজেলায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সব থেকে ভুট্টা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়াও তরমুজ, কুল, আমের মুকুল ক্ষতি হয়েছে। তবে ধানের কম ক্ষতি হয়েছে। এমন ক্ষয়ক্ষতি আগে কখনো দেখিনি আমরা। অনান্য উপজেলার চেয়ে সদরে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলের। তবে ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করতে একটু সময় লাগবে বলে তিনি জানান।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামাদুল হক জানান, এমন শিলাবৃষ্টি চুয়াডাঙ্গাবাসী আগে কখনো দেখেছে কি-না জানি না। দুপুর ৩টা ১০ থেকে ৪টা পর্যন্ত ১৭ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। এক ইঞ্চি পরিমাণ শিলাসহ ওই সময় বাতাসের গতিবেগ ছিলো ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, মেহেরপুরে শিলাবৃষ্টিতে উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। রোববার (২৭ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে বৃষ্টির সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে গম, মসুরি ও তামাক ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, চলতি মরসুমে জেলায় সাড়ে ১২ হাজার হেক্টর জমিতে বারি গম-৩৩, বারি গম ৩২ ও বারি গম ২৬ জাতের গমের আবাদ হয়েছে। ভুট্টার আবাদ হয়েছে ১৩ হাজার ৮৩০ হেক্টর ও মসুরি আবাদ হয়েছে সাত হাজার ৮৫ হেক্টর জমিতে। চাষিদের আবাদি জমির গম এখন দানা বাঁধার সময়। সদর উপজেলা আমঝুপি ইউনিয়নের কৃষক জাহেদুর রহমান জানান, দুইবিঘা জমিতে ভুট্টার আবাদ করেছিলেন। শিলাবৃষ্টিতে গাছের পাতা ছিঁড়ে গেছে। হোসাইন সাগর নামের আরেক কৃষক জানান, এক বিঘা জমিতে গম ও ১০ কাঠা জমিতে মসুরি আবাদ করি। শিলাবৃষ্টিতে গম গাছ মাটিতে পড়ে গেছে। মসুরি ক্ষেতের ফুল ঝরে গেছে। স্থানীয় কৃষকরা আরও জানান, শিলাবৃষ্টির ফলে রবি শস্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে ভুট্টা, গম, কলা, আমের মুকুল, লিচু, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল। তবে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যায়নি। মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ বলেন, শিলাবৃষ্টিতে গম, ভুট্টা ও মসুরি গাছের ক্ষতি হয়েছে। হঠাৎ শিলাবৃষ্টি হলেও বর্তমানে আবহাওয়া ভালো। মাঠ পর্যায়ে লোক পাঠানো হয়েছে। ক্ষতি কমাতে চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ঝিনাইদহের জেলায় হঠাৎ ঝড়ো হাওয়া ও শিলাবৃষ্টিপাতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে গম, মসুর, ভুট্টা, পান ও আমের মুকুলের। গতকাল রোববার বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত এ ঝড়-বৃষ্টি হয়। এ সময় ১৫ সেকেন্ড ধরে শিলা পড়তে থাকে। সদর উপজেলার শহরের পাশ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের তথ্য নিয়ে জানা যায়, মাটিতে নুয়ে পড়েছে গম, ভেঙে গেছে ভুট্টাক্ষেত ও আমের মুকুল। কোনো কোনো স্থানে পানের বরজের চালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টিতে ফুলকপি, শিমসহ অন্যান্য ফসলেরও ক্ষতির শঙ্কা করছেন কৃষকেরা। তবে কী পরিমাণ ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তা এখন জানাতে পারেনি কৃষি বিভাগ।
সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান সাদ আহমেদ বিশ্বাস জানান, হঠাৎ শিলাবৃষ্টিতে তার এলাকার কৃষক অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তার নিজের দুই বিঘা জমিতে ভুট্টা ছিলো। এই ঝড়ে ক্ষেতের এক-তৃতীয়াংশ গাছ মাটিতে নুয়ে গেছে। এছাড়া তার মসর, গম ও আমের মুকুলের অনেক ক্ষতি হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আজগর আলী বলেন, ক্ষণস্থায়ী শীলাবৃষ্টিতে ফসলের অনেক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে মসুর, গম, ভুট্টা, পান ও আমের অনেক ক্ষতি হতে পারে। তবে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে, তা আগামীকাল (আজ সোমবার) জানা যাবে। তবে কৃষক যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে পারেন, তাহলে ক্ষতি কমে আসবে।