স্টাফ রিপোর্টার: শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়াতে স্কুল পর্যায়ে করোনার টিকা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও টিকা পাবে না অর্ধকোটি শিক্ষার্থী। বেসরকারি পর্যায়ের (কিন্ডারগার্টেন) স্কুল পড়–য়া শিক্ষার্থীদের টিকার রেজিস্ট্রেশন করারও সুযোগ নেই। বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত স্কুলের শিক্ষার্থীরাও টিকা পাবে না। এমনকি খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিক্ষার্থীদের টিকা নিতে নাম নিবন্ধনের কোনো চিঠিও পাননি ব্যুরোপ্রধান। এছাড়া স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া কোনো শিশুকেও টিকার আওতায় আনার উদ্যোগ নেই। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে পর্যায়ক্রমে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই করোনার টিকার আওতায় আসবে। প্রথম পর্যায়ে শুধু সরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুলের শিক্ষার্থীরাই এই টিকা পাবে। অর্থাৎ দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে স্কুলশিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা ১২ থেকে ১৭ বছরের বয়সসীমায় রয়েছে তাদের টিকা দেয়ার কার্যক্রম শুরু হলেও বাদ পড়ছে প্রায় অর্ধকোটি শিক্ষার্থী। এসব শির্ক্ষার্থী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথা কিন্ডারগার্টেন ও বিভিন্ন এনজিও পরিচালিত স্কুলে পড়াশোনা করে। এই বিশাল সংখ্যাক শিক্ষার্থী আপাতত করোনার টিকা পাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত ১৩ অক্টোবর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থীদের টিকা দেয়া শুরু হয়েছে। প্রথম দিন মানিকগঞ্জের দু’টি স্কুলে শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। এর আগে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, চলতি মাস থেকেই ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের টিকাদান কর্মসূচি শুরু হবে। তিনি আরো জানিয়েছিলেন, আপাতত সারা দেশের জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে ২১টি কেন্দ্রে স্কুলশিক্ষার্থীদের ফাইজারের টিকা দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে স্কুলশিক্ষার্থীদের তালিকা সরবরাহ করবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেই অনুযায়ী জন্মনিবন্ধন সনদ দিয়ে সুরক্ষা অ্যাপসে টিকার নিবন্ধন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী জানান, দেশে বর্তমানে কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যাও প্রায় এক কোটি। এর মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। আর মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর অর্থাৎ সরকারের সিদ্ধান্ত মতো যারা টিকা পাওয়ার উপযুক্ত তাদের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। এই শিক্ষার্থীদের সংখ্যাও ৩৫ লাখ থেকে ৪০ লাখের কাছাকাছি। কিন্তু কিন্ডারগার্টেনে পড়াশোনা করার কারণে এই শিক্ষার্থীরা করোনার টিকা পাচ্ছে না। তবে আমরা বিষয়টি নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা করব। কিভাবে এবং কত তাড়াতাড়ি তাদের টিকার আওতায় নিয়ে আসা যায় সেটারও উদ্যোগ নেব।
অন্য দিকে দেশে এখন বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। এদের মধ্যে ব্র্যাক, আশা ও ইউসেফ অন্যতম। এদের বাইরে আরো কিছু স্কুল (নৈশ বা দিবা) রয়েছে যেখানে একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যার শিক্ষার্থী রয়েছে। এসব ভাসমান ও এনজিও পরিচালিত স্কুলের পাঁচ থেকে ছয় লাখ শিক্ষার্থী এই মুহূর্তে করোনার টিকার আওতায় আসছে না। বেসরকারি সংস্থা আশার এক কর্মকর্তা জানান, আমাদের এনজিওদের দ্বারা পরিচালিত স্কুলে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সের অনেক শিক্ষার্থী থাকলেও সরকারের ঘোষণার অভাবে এসব শিক্ষার্থী টিকা পাচ্ছে না।
শুধু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই নয়, প্রথম দফায় করোনার টিকা পাচ্ছে না খোদ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরো পরিচালিত সারা দেশের শিক্ষাকেন্দ্রের অনেক শিক্ষার্থীও। দেশব্যাপী উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর অধীনে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে দু’টি ক্যাটাগরিতে পড়াশোনা চালানো হচ্ছে। প্রথম ক্যাটাগরিতে রয়েছে ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সের শিক্ষার্থী। আর দ্বিতীয় ক্যাটাগরিতে রয়েছে ১৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সের বয়স্ক শিক্ষার্থী। এদের মধ্যে প্রথম ক্যাটাগরির ১২ থেকে ১৪ বছর এবং দ্বিতীয় ক্যাটাগরির ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সের শিক্ষার্থীরাও করোনার টিকা পাবে না। অর্থাৎ দুই ক্যাটাগরিতে মিলে যাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছর (গড় হিসেবে এই সংখ্যা তিন থেকে চার লাখ) তারাও কেউ টিকা পাচ্ছে না।
উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাব্যুরোর (বিএনএফই) মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মো: আতাউর রহমান গতকাল রোববার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের জানান, আমাদের দু’টি ক্যাটাগরির কোনো শিক্ষার্থীই প্রথম দফায় করোনার টিকা পাচ্ছে না। তবে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দ্বিতীয় দফায় টিকা দেয়া শুরু হলে আশা করছি সবাই তখন টিকার আওতায় চলে আসতে পারবে। আমরা প্রথম দফায় করোনার টিকা পাওয়ার কোনো চিঠিও পাইনি।
সংশ্লিষ্টদের মতে সরকারি, বেসরকারি, এমপিওভুক্ত, কিন্ডারগার্টেন, উপানুষ্ঠানিক ব্যুরো এবং এনজিও দ্বারা পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরেও অনেক ছেলেমেয়ে রয়েছে যারা কোথাও লেখাপড়া করে না কিংবা করোনা বা অন্য কোনো কারণে পড়ালেখা থেকে তারা সরে গেছে। অথচ তাদের বয়স ১২ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। কিন্তু সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী অর্ধকোটির এই বিশাল সংখ্যক ছেলেমেয়েরাও টিকার আওতায় আসছে না। তাই সরকারকে বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেয়ার জন্য অভিমত ব্যক্ত করেছেন অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষাবিদরা।
স্কুলশিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনতে স্কুলভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন ও নাম নিবন্ধনের দায়িত্ব পালন করছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। মাউশির পরিচালক (বিদ্যালয়) মো: বেলাল হোসাইন জানান, সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রথম দফায় শুধু সরকারি এবং এমপিওভুক্ত বা রেজিস্ট্রার্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। তবে এটা প্রথম ধাপ। এরপর পর্যায়ক্রমে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সব শিক্ষার্থীই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। তখন আর কোনো শিক্ষার্থীই টিকার আওতার বাইরে থাকবে না।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা এবং সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী পর্যায়ক্রমে স্কুলের সব শিক্ষার্থীকেই টিকার আওতার আনার মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রতি দিন ২১ কেন্দ্রে ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে দেয়া হবে করোনার টিকা। তারই অংশ হিসেবে ব্যাপক পরিসরে স্কুলশিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনতে পরিকল্পনাও চূড়ান্ত করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)।
মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো: গোলাম ফারুক জানান, ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে প্রতিদিন টিকা দেয়া হবে। আশা করছি আগামী ৩০ অক্টোবর থেকে এ কার্যক্রম শুরু হবে। তিনি আরো বলেন, ঢাকা মহানগরীর স্কুল ও কলেজ মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে ৭৮৩টি। এখানে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৬ লাখ ১৫ হাজার। আমরা এদের প্রথম ধাপে টিকার আওতায় আনবো। এরপর ব্যাপকভাবে আমাদের কার্যক্রম শুরু হবে। তখন সব শিক্ষার্থীই নিশ্চিতভাবে টিকা পাবে।