আফজালুল হক: চুয়াডাঙ্গায় শীতে ব্যাপকহারে রোটা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে শিশু ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা। বাড়ছে শিশুদের নিউমোনিয়ার সংখ্যা। গত ৭ দিনে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে শিশুসহ ২৬৮ রোগী ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছে। শিশু ওয়ার্ডে নিউমোনিয়ায় ভর্তি হয়েছে ৪০ শিশু। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ শিশু রোটা ভাইরাসে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে শিশু ওয়ার্ডে এক শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। চুয়াডাঙ্গা সদরের শংকরচন্দ্র ইউনিয়নের হানুরবাড়াদী গ্রামের আলমগীর-মিতা দম্পতির মেয়ে চিকিৎসারত অবস্থায় মৃত্যু হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহবুবুর রহমান মিলন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, গত ২৪ ডিসেম্বর শিশুটি ভুমিষ্টের পরই শ্বাসকষ্ট শুরু হলে সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। গতকাল দুপুরে শিশুটির মৃত্যু হয়। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, গত ৭ দিনে (গতকাল রাত ৯ টা পর্যন্ত) ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছে শিশুসহ ২৬৮ রোগী এবং নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ৪০ শিশু ভর্তি হয়েছে। এছাড়াও বহির্বিভাগে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়াসহ শীতজনিত বিভিন্ন রোগে হাসপাতালের আউটডোরে প্রায় চার শতাধিক শিশু, বয়োবৃদ্ধরা চিকিৎসা নিচ্ছেন। ডায়রিয়া ওয়ার্ডের ইনচার্জ জানান, শীতজনিত কারণে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এর সিংহভাগই শিশু রোগী। চিকিৎসাসেবা দিতেও আমাদের কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেশ কিছুদিন কলেরা স্যালাইন সাপ্লাই ছিলোনা। গতকাল হাসপাতালে পৌঁছেছে বলে শুনেছি। আজ থেকে ওয়ার্ডে কলেরা স্যালাইনসহ যাবতীয় ওষুধ সরবরাহ করা হবে। গতকাল মঙ্গলবার রাতে ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে সরজেমিনে গিয়ে দেখা যায়, রোগীতে কানায় কানায় পূর্ণ দুই ওয়ার্ডে। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে বেশিরভাগই শিশু রোগী দেখা গেছে। এতে সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন নার্সরা। তবে সাধ্যমতো সেবা দেয়ায় নার্সদের প্রতি রোগী ও স্বজনদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করতেও শোনা যায়। এছাড়াও চিকিৎসা সেবা নিয়েও কোনো অভিযোগ করেনি কেউ। সবাই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে। ডায়রিয়া আক্রান্ত একাধিক শিশু রোগীর স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের। তারা জানান, হঠাৎ করেই শিশুদের ডায়রিয়া এবং বমি শুরু হচ্ছে। বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসা করেও কম না হলে হাসপাতালে নিয়েছি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন চিন্তার কোনো কারণ নেই। শীতজনিত রোটাভাইরাসের জন্য ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেন, আগের তুলনায় চিকিৎসা সেবা ভালো হয়েছে। বাচ্চাদের কোনো সমস্যা হলে নার্সের ডাকার সঙ্গে সঙ্গেই সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসককে জানানো হলে তিনিও তাৎক্ষণিক এসে চিকিৎসা দিচ্ছেন। কলেরা ও খাওয়ার স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধ হাসপাতাল থেকেই দিচ্ছে। ফয়সাল বিশ্বাস নামে এক যুবক দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, গত পরশু বিকেলে বাইরের ফুসকা খাওয়ার পরই গ্যাস্টিকের সমস্যা অনুভব করি। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে গ্যাস্টিকের ওষুধ খেলেও কম হয়নি। রাত থেকে হঠাৎ শুরু হয় ডায়রিয়া ও বমি। গতকাল সকালে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। কলেরা স্যালাইন হাসপাতালে না থাকায় বাইরের ফার্মেসি থেকে কিনতে হয়েছে। খাবার স্যালাইনসহ অন্যান্য ওষুধ কিছুই কেনা লাগেনি। সব হাসপাতাল থেকেই দিচ্ছে। চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি নেই। নারগিস খাতুন জানান, আমার ছেলের বয়স চার বছর। চারদিন আগে হঠাৎ বমি ও পাতলা মল শুরু হয়। পরের দিন হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসক ভর্তি করে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে পাঠান। শীতে একটু কষ্ট হলেও চিকিৎসায় কোনো ঘাটতি নেই। ডাক্তার বলেছেন রোটা ভাইরাসের কারণে পানি শূন্যতা হয়ে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়েছে। ২-৩ দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে যাবে ছেলে। নিউমোনিয়া আক্রান্ত সিফাত রহমানের মা বলেন, হঠাৎ করে ছেলের জ্বর, ঠান্ডা, কাশি শুরু হয়। দুদিন আগে হাসপাতালে নিয়ে আসলে চিকিৎসক ভর্তি করে শিশু ওয়ার্ডে পাঠায়। ওয়ার্ডে কোনো জায়গা নেই। এই শীতে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে মেঝেতেই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় শিশু ওয়ার্ডে বেশিরভাগ রোগী মেঝেতে চিকিৎসা নিচ্ছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে রোগীর স্বজনদের। হাসপাতালে স্টোর কিপার হাদিউর রহমান হাদি বলেন, কলেরা স্যালাইন ও খাওয়া স্যালাইনের কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত পরিমাণ সরবরাহ আছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. আতাউর রহমান দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, সদর হাসপাতালে রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে। বেশিরভাগই শিশু রোগী। বেড়েছে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যাও। এছাড়া প্রতিদিন বহির্বিভাগে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে ৩০০-৪০০ শিশু রোগীকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ আসাদুর রহমান মালিক খোকন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, শীতে রোটাভাইরাস জনিত কারণে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এছাড়া নিউমোনিয়া, শ্বাসকষ্ট, সর্দি, কাশি, জ্বর, আক্রান্ত হয়ে শিশুরা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ডায়রিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিউমোনিয়া আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাও বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, শিশুদের ঠিকমতো টিকা প্রদান ও ৬ মাস বয়স পর্যন্ত মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো হলে নিউমোনিয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। তাছাড়া ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে শিশুকে দূরে রাখা এবং গরম কাপড় পরিধান করানো অত্যন্ত জরুরি। ডায়রিয়া এক ধরনের পানিবাহিত রোগ। রোটা ভাইরাসের কারণে ডায়রিয়া হয়ে থাকে। ৬-১৬ মাস বয়সি আক্রান্ত শিশুকে ঘনঘন স্যালাইন ও মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। এছাড়া শিশুদের মায়ের বুকের দুধ ও রোটারিং টিকা দিলে ডায়রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম থাকে। তিনি আরও বলেন, এসব রোগ থেকে রক্ষা পেতে শিশুদের ছয় মাস বয়স পর্যন্ত নিয়মিত বুকের দুধ পান করাতে হবে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। শিশুদের জ্বর, অস্বাভাবিক কাশি ও পাতলা পায়খানা দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নেয়ার পরামর্শও দেন তিনি।