স্টাফ রিপোর্টার: মেহেরপুরে একের পর এক অনলাইন জুয়ার দুর্গে পুলিশ ও সাইবারক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল হানা দিয়ে মাস্টারমাইন্ডসহ জেলার শীর্ষ জুয়াড়িদের গ্রেফতার করায় গা ঢাকা দিয়েছেন এজেন্টরা। এখন অন্যত্র থেকে চালাচ্ছেন লেনদেন, সর্বস্বান্ত হচ্ছেন এলাকার মানুষ।
গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, মেহেরপুর জেলায় অনলাইন জুয়ার ২৩১টি সাইটে খেলছেন কয়েক হাজার যুবক ও তরুণ। প্রতিমাসে এ জেলা থেকে প্রায় ৪শ কোটি টাকা রাশিয়ায় পাচার করছে এই জুয়াড়িরা। সে হিসেবে গত আড়াই বছরে প্রায় ১২-১৩ হাজার কোটি টাকা শুধু এই জেলার অনলাইন জুয়াড়িদের মাধ্যমে রাশিয়ায় পাচার হয়েছে। যদিও এখন জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগ এই অনলাইন জুয়া বন্ধে আইন প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করার কাজ করছে। ইতোমধ্যে জেলার শীর্ষ ৩২ জন অনলাইন জুয়াড়িকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বাদল হালদারের ছেলে নিমাই হালদার ও গোপালপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার খলিলুর রহমানের ছেলে বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েল (৩৬), কোমরপুর গ্রামের মধু হালদারের ছেলে প্রসেনজিৎ হালদার (২৫), নজরুল ইসলামের ছেলে সুমন আলী (৪০), মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাব (২৮), আব্দুর রশিদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন (৩০), গোপালপুর গ্রামের বদরুদ্দোজা রয়েল, কোমরপুর গ্রামের মোস্তাফিজুর রহমান সুমন, নিমাই হালদার, নুরুজ্জামান ওরফে জামান মাস্টার, মুকুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টার, মাদার আলী ওরফে মাদার মাস্টার, গোপালপুর গ্রামের পলাশ, কোমরপুর গ্রামের বিলু সর্দারের ছেলে শামীম রেজা, গাংনী উপজেলা শহরের উত্তপাড়া এলাকার মৃত আব্দুল কুদ্দুছের ছেলে মেহেরপুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি শাহিদুজ্জামান শিপু, বঙ্গবন্ধু সৈনিকলীগের গাংনী উপজেলা শাখার সভাপতি ও গাংনী সরকারি ডিগ্রি কলেজের ক্লার্ক রবিউল ইসলাম, সাবেক ছাত্র নেতা জুবায়ের হোসেন উজ্জ্বল, বিপুল হোসেন চঞ্চল হোসেন ও জিয়াউর রহমান।
মেহেরপুর জেলা থেকে দুই শতাধিক এজেন্ট অনলাইন জুয়া সাইটের মাধ্যমে প্রতি মাসে রাশিয়ায় পাচার হচ্ছে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। আর এই অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত মেহেরপুরের সরকার দলীয় কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতা, মুজিবনগর উপজেলার একজন প্রভাবশালী ইউপি চেয়ারম্যান, সরকার সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ নেতা, প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা, স্কুল ও কলেজের শিক্ষক, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির দুই শতাধিক ব্যক্তি।
অভিযোগ আছে কিছু পুলিশ কর্মকর্তা, কিছু রাজনৈতিক নেতা এবং সাংবাদিক নিয়মিত মাসোহারা নেন অনলাইন জুয়ায় জড়িত এজেন্টদের কাছ থেকে। তাদের মাসোহারা দিয়ে দেদারছে জুয়া খেলে কোটিপতি বনে যাচ্ছেন এসব এজেন্ট। আর পথে বসছেন হাজার হাজার তরুণসহ জুয়া খেলায় জড়িতরা। পুলিশ ও সাইবারক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেলের অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, সঠিক নজরদারি না থাকায় অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে প্রতিদিনই কোটি টাকা পাচার হচ্ছে দেশের বাইরে। এতে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি বিপথে যাচ্ছেন তরুণ ও যুবকরা। কোমরপুর গ্রামের গ্রেফতারকৃত এক জুয়াড়ির মাত্র একটি সিম কার্ড (এজেন্ট) থেকেই একমাসে লেনদেন হয়েছে এক কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
সম্প্রতি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে মুজিবনগর উপজেলার কোমরপুর গ্রামের বাদল হালদারের ছেলে নিমাই হালদার ও গোপালপুর দক্ষিণপাড়া এলাকার খলিলুর রহমানের ছেলে বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েলকে (৩৬) গ্রেফতারের পর তার কাছ থেকে এমন তথ্য পাওয়া যায়।
জেলার বিভিন্ন স্থানে অনুসন্ধান এবং কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্টে অনলাইন জুয়া নিয়ে উঠে এসেছে নানা তথ্য। সম্প্রতি ডিবি, সাইবার ক্রাইম বিভাগ মুজিবনগর থানা পুলিশ ও গাংনী থানা পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে।
মামলার আসামি বদরুদ্দোজা ওরফে রয়েল জিজ্ঞাসাবাদে সাইবার ক্রাইমকে জানিয়েছে, মেহেরপুরসহ বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার (ওয়ান এক্সবেট) মাস্টার এজেন্ট কোমরপুর গ্রামের সোনা গাইনের ছেলে মাহফুজুর রহমান ওরফে নবাব। এছাড়া তার নেতৃত্বে অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত আছে আরও ১৫ জন সাব-এজেন্ট। তারা হলেন- গোপালপুর গ্রামের আমিরুল ইসলামের ছেলে শিশির বিশ্বাস, বিল্লাল গড়াইয়ের ছেলে দিপু, কোমরপুর গ্রামের বিলু সর্দারের ছেলে শামীম, একই গ্রামের আনারুল মিয়ার ছেলে রুবেল, টঙ্গীর শরিফের ছেলে পলাশ, মুজিবনগরের শিবপুরের মৃত শাহাজুলের ছেলে বিজয়, একই গ্রামের জিনারুলের ছেলে লিপু গাজী, মোনাখালী গ্রামের আজহারুলের ছেলে মিলন, সাইদুর রহমান খোকনের ছেলে সাগর, কোমরপুর গ্রামের বাশার বিশ্বাসের ছেলে সজীব, ভাটপাড়া গ্রামের মৃত সিরাজ ম-লের ছেলে বাবু, মেহেরপুর শহরের স্টেডিয়াম পাড়ার বখতিয়ার মাস্টারের ছেলে রুবেল, গাংনীর গাড়াডোব গ্রামের মৃত কিয়াম উদ্দিনের ছেলে আনেয়ার।
মেহেরপুর জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) ও সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন সেল একের পর এক অনলাইন জুয়ার দুর্গে হানা দেয়া শুরু করেছে। অভিযানে এসব জুয়াড়ি গ্রেফতারের পর বাকিরা এলাকা থেকে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ডিবি পুলিশের একটি সূত্র।
ওই গোয়েন্দা সংস্থার মতে, মেহেরপুর জেলাতে কোনোভাবেই লাগাম টানা যাচ্ছে না অনলাইন জুয়ার। রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছেন অনেকে। জুয়াড়িরা বিভিন্ন অ্যাপ ও সাইট ব্যবহার করে অনলাইনে বিভিন্ন গেমিং বেটিং বা বাজি খেলার সাইটে জুয়ায় মেতে উঠেছে।
বিট কয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার (ক্রিপ্টোকারেনসি) মাধ্যমে অনলাইনে জুয়া খেলা হয়। অবৈধ পন্থায় ডিজিটাল মুদ্রা কেনাবেচার লেনদেনে আড়াই বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশে এই টাকা পাচার হয়েছে বলে জানায় সংস্থাগুলো। রাশিয়া থেকে পরিচালিত এসব অনলাইন জুয়ার সাইট ও অ্যাপস তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যায়ে পর্যন্ত। এসব জুয়ার সাইট ও অ্যাপস ভার্চুয়ালি জুয়া খেলায় একেকটি এজেন্টের মাধ্যমে মাসে ৩ থেকে ৪ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে।
এর মধ্যে ডিবির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টেগেশন সেল অনলাইন জুয়াচক্রের ৩২ সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। ইতোমধ্যে জেলার অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িতদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। অনলাইন জুয়া বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতেও তারা কাজ শুরু করেছে।
জানা গেছে, অনলাইনে ওয়ানএক্সবিট, বেট ৩৬৫ ডটকম, প্লেবেট ৩৬৫ ডটকম, বিডিটি ১০ ডটকম, উইনস ৬৫ ডটকম ও বেটস্কোর ২৪ ডটকমসহ মোট ২৩০টি সাইটের মাধ্যমে এই জুয়া খেলা পরিচালিত হচ্ছে।
জেলা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, রয়েল নামের ওই অনলাইন জুয়াড়িকে গ্রেফতারের পর মামলা করা হয়। মামলাটি তদন্তের একপর্যায়ে এ চক্রের সদস্যদের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য, তাদের ২৩০টি জুয়ার সাইটের মালিক ও এজেন্ট সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে। মেহেরপুরে জেলা শহরসহ মুজিবনগর এলাকার তরুণদের বড় অংশই এখন জুয়ার সাইট পরিচালনায় যুক্ত। তিনি আরও জানান, একজন জুয়ড়ি মোবাইল নম্বর, ইমেইলের মাধ্যমে এই বেটিং সাইট ওপেন করেন। অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি ইওয়ালেট তৈরি হয় যাকে জুয়াড়িরা ইউএসডিটি বলে। শুরুতে এর ব্যালান্স শূন্য থাকে। ওয়ালেটে ব্যালান্স যোগ করার জন্য অনেক মাধ্যম রয়েছে। এর মধ্যে বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায় এবং ট্রাস্ট এজিয়াটা অন্যতম। এগুলোর যে কোনো একটি বেছে নিলে সেখানে একটি এজেন্ট নম্বর দেখায় যেখানে ন্যূনতম ৫০০ টাকা দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে ইওয়ালেট বা ইউএসডিটি ব্যালান্স যুক্ত হয়ে যায়। এ টাকা অথবা ব্যালান্স দিয়ে তিনি পরবর্তীতে জুয়া খেলতে পারেন। প্রতিটি এজেন্ট আগে ৬ শতাংশ কমিশন পেতেন। এখন চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাওয়ায় এজেন্ট ধরে রাখতে তারা ৯ শতাংশ কমিশন পায়।
মেহেরপুর জেলা ডিবি পুলিশের ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত এ পর্যন্ত ৩২ এজেন্টকে আটক করা হয়েছে। জড়িতদের আটকে অভিযান চলছে। অভিযানের পর থেকে অনেক এজেন্ট গা ঢাকা দিয়েছেন।