স্টাফ রিপোর্টার: আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দিয়ে মেহেরপুর শহরের শিশু বাগানপাড়া থেকে তিন পরিবারের শিশু ও নারীসহ ১৮ জনকে জঙ্গি সন্দেহে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় এলাকায় জঙ্গি আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এছাড়া এটি জঙ্গি তৎপরতা নাকি অন্য কিছু এ নিয়ে এখন শুরু হয়েছে নানা জল্পনা-কল্পনা। তুলে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা হলেন শিশু বাগানপাড়ার ইদ্রিস আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন (৩০), কিতাব আলীর ছেলে সেন্টু হোসেন (২৮), তার স্ত্রী দিলরুবা খাতুন (২৫), ছেলে লাসিন ও হুজাইফা, একই পাড়ার রিকশাচালক পলাশ (৫৫), তার স্ত্রী ফাতেমা খাতুন (৪৮), মেয়ে ফারহানা, ফারহানার স্বামী মিনারুল ইসলাম, মেয়ে মিতা খাতুন ও রিতা খাতুন, পলাশের অন্য মেয়ে প্রিয়া ও তার স্বামী ঝন্টু মিয়া, পলাশের অন্য ছেলে ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রী শাহিনুর খাতুন, তাদের ছেলে বুখারি এবং পলাশের অন্য ছেলে ফয়সাল হোসেন।
এদিকে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে একই পাড়ার মাংস বিক্রেতা রফিকুল ইসলামের ছেলে রাকিব মোল্লা ওরফে মুজাহিদ (৩০)। তাদের মধ্যে ফরহাদের ছেলে বুখারি, পলাশের ছেলে ফয়সাল, মিনারুল ইসলামের মেয়ে মিতা, সেন্টু হোসেনের ছেলে লাসিন ও হুজাইফাকে গত মঙ্গলবার মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের মাধ্যমে তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে ফেরত দিয়ে গেছে। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাদের এক প্রতিবেশী জানিয়েছেন, তুলে নিয়ে যাওয়া এসব ব্যক্তিরা জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পুলিশের কাছে এই তালিকায় ১৮ জনের নাম আছে বলেও জানান তিনি। এর আগে গত ৩ আগস্ট রাত ১টার দিকে শিশু বাগানপাড়া এলাকার ইদ্রিস আলী মিস্ত্রির ছেলে স্ট্রিট ফুড বিক্রেতা আনোয়ার হোসেনকে (৩০) তার বাড়ি থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীর পরিচয় দিয়ে তুলে নিয়ে যায়। আনোয়ার হোসেনের মা আনোয়ারা খাতুন ও বাবা ইদ্রিস আলী মিস্ত্রি বলেন, ছেলেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় তাদের দুজনের পরনে পুলিশের পোশাক এবং অন্যরা সাদা পোশাকে ছিলেন। আনোয়ারের স্ত্রী পলি খাতুন বলেন, তারা বলেছিলেন, দুই একটা কথা জিজ্ঞেস করে এখনি ছেড়ে দিয়ে যাবেন। সেই যে নিয়ে গেলো, তারপর থেকে আর কোনো খোঁজ পাইনি। তিনি আরও বলেন, আনোয়ারকে নিয়ে যাওয়ার পর মোট পাঁচ বার থানা, র্যাব, ও পুলিশ অফিসে গিয়েছি। কোনো খোঁজ পাইনি। সেখানে না পেয়ে তারা জেলার অন্যান্য উপজেলার পুলিশ স্টেশন, র্যাব ও ডিবি অফিসে সন্ধান করেছি। কিন্তু সেসব জায়গায়ও আনোয়ার হোসেনকে পাওয়া যায়নি। পরে থানায় জিডি দিতে গেলে তারা জিডি নেয়নি। গত ৩ আগস্ট আনোয়ার হোসেনকে বাড়ি থেকে তুলে নেয়ার পর থেকে সেন্টু হোসেন ও পলাশের পুরো পরিবার পালিয়ে যাওয়ার সময় দামুড়হুদা এলাকা থেকে পরের দিন তাদের আটক করা হয়।
জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, আটকরা জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সক্রিয় সদস্য। ঢাকা থেকে পুলিশের এন্টি-টেরোরিজম ইউনিটের একটি গ্রুপ মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সহযোগিতায় তাদের আটকের পর ঢাকায় নিয়ে গেছে। আটক ৬ শিশুর মধ্যে ৫ জন শিশুকে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের মাধ্যমে তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছে ফেরত দেয়া হয়েছে।
এদিকে সেন্টু হোসেনের দুই ছেলে লাসিন (৮) ও হুজাইফাকে (৩) ফেরত পেয়েছেন তার দাদি আদরী খাতুন। এর মধ্যে হুজাইফার একটি পা ভেঙে গেছে।
সেন্টুর মা আদুরি খাতুন বলেন, এ দুই দুধের শিশু নিয়ে আমি এখন কি করবো। কুল কিনারা পাচ্ছি না। বোন পাপিয়া খাতুন বলেন, আমার ভাইকে ধরে নিয়ে কোথায় রেখেছে সেটা তো আমরা জানার অধিকার রাখি। তারা অন্যায় করলে সাজা হোক। কিন্তু আমাদের পরিবারকে খোঁজ দিক। বৃহস্পতিবার দুপুরে সেন্টু হোসেন ও আনোয়ারের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সবাই বারান্দায় বসে আছেন। তাদের সান্ত¡না দিতে পড়শিদের কয়েকজনও সেখানে আছেন। এছাড়া পলাশ ও রাকিব মোল্লার বাড়িতে গিয়ে তাদের বাড়িতে তালা মারা দেখা গেছে। পলাশের ফেরত দেয়া ছেলে ফয়সাল ও ফরহাদের ছেলে বুখারীকে পাওয়া যায়নি। তারা তাদের কোনো আত্মীয়র বাড়িতে গেছে তাও বলতে পারেননি প্রতিবেশীরা।
আনোয়ার হোসেনের মা আনোয়ারা খাতুন জানান, রাত ১টার পরপরই দুজন পুলিশের পোশাক পরে আর চারজন শাদা পোশাকে প্রাচীর টপকে বাড়িতে প্রবেশ করে। আইনের লোক পরিচয় দিয়ে ছেলেকে তুলে নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলে। সকালে থানায়, ডিবি কার্যালয়, র্যাব ক্যাম্পে গেলে কেউ স্বীকার করেনি ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার কথা।
আনোয়ারের স্ত্রী পলি খাতুন বলেন, স্বামীর সন্ধানে অনেক জায়গায় গিয়েছি, কোথাও সন্ধান মিললো না। আমার স্বামী নিরপরাধ। তাকে কেন রাতের আঁধারে তুলে নেয়া হলো তা বুঝতে পারছি না।
প্রতিবেশী জাহিদ হোসেন বলেন, আনোয়ার ফুটপাতে ব্যবসা করতেন। তবে, নিয়মিত মসজিদে যাওয়ার আহ্বান জানাতেন। ধারণা করা হচ্ছে, জঙ্গি সম্পৃক্ততার সন্দেহে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন তাকে তুলে নিয়ে গেছে। তবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত বিষয়টি পরিবারটিকে জানানো। যদি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে না নিয়ে থাকে তাহলে তাদেরই উচিত আনোয়ারকে খুঁজে বের করা।
মেহেরপুর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, পুলিশ আনোয়ারসহ অন্যদের আটক করেনি। অন্য কোনো সংস্থা তাদের আটক করেছে কিনা জানা নেই।