স্টাফ রিপোর্টার: হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন সোনিয়া। বুকের ওপর রাখা মেহেদিরাঙা বাঁ হাতে ক্যানুলার ছিদ্রের পাশে জমে আছে রক্তকণা। স্বামী শামীম হোসেন মারা যাওয়ার খবরটি জানানো হয়নি তাকে। আত্মীয়-স্বজনরা তাকে দেখতে এলে সোনিয়া বারবার স্বামীর খোঁজ করছেন। ‘আমি শামীমির সাতে দ্যাকা করতি চাই। নিজ চোকি তার দেকতি চাই সে অ্যাকন ক্যারাম আচে। তুমরা আমার শামীমির কাচে নি চলো।’ ঘুম ভাঙলেই স্বামীকে একনজর দেখতে এভাবে অস্থির হয়ে উঠছেন সোনিয়া খাতুন। সোনিয়ার এমন আহাজারিতে হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, রোগী ও তাদের স্বজনদেরও ভারাক্রান্ত করে তুলছে। তাকে সান্ত¡না দিতে গিয়ে অঝোরে কাঁদছেন মা চম্পা খাতুনসহ স্বজনেরা। দুর্ঘটনায় ডান হাত ও দুই পা ভেঙে গেছে সোনিয়ার। প্রচ- ব্যথার কারণে তাকে বেশির ভাগ সময় ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে। সোনিয়া খাতুনের অস্ত্রোপচারে অন্তত ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা লাগবে বলে জানিয়েছেন নিউ ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়্যারম্যান রফিকুল ইসলাম। এতো টাকা কীভাবে জোগাড় করবেন তা নিয়ে চিন্তিত স্বজনেরা।
গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টার দিকে চুয়াডাঙ্গার হিজলগাড়ীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সোনিয়ার স্বামী শামীম হোসেন (২২) মারা গেছেন। ওই মোটরসাইকেলে থাকা সোনিয়া গুরুতর আহত হয়েছেন। সোনিয়া স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী। নিহত শামীম বেগমপুর ইউনিয়নের ফুরশেদপুর গ্রামের নওদাপাড়ার মৃত শফিউদ্দিনের ছেলে। ওই দুর্ঘটনায় সোনিয়া ও তার খালাতো ভাইয়ের স্ত্রী শেফালি খাতুন আহত হয়েছেন। শেফালি খাতুন তিতুদহ ইউনিয়নের বলদিয়া গ্রামের বিশ্বাসপাড়ার সজীব মিয়ার স্ত্রী। গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় জানাজা শেষে শামীমের লাশ নিজ গ্রামে দাফন করা হয়েছে। আহত সোনিয়ার অবস্থা গুরুতর হওয়ায় চিকিৎসকেরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। তবে অর্থের অভাবে তাকে রাজশাহী নিতে পারেননি স্বজনেরা। বর্তমানে সোনিয়া চুয়াডাঙ্গার নিউ ইউনাইটেড ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন।
অসুস্থ সোনিয়ার পাশে মা চম্পা খাতুন ছাড়াও ছিলেন মামা খায়রুল ইসলাম, ছোট খালা পপি খাতুন ও খালু বিল্লাল হোসেন। পপি খাতুন বলেন, ‘মেয়ে শুধু বলছে, তোমার জামুই ক্যারাম আচে? আমি বুলচি, ভালোই আচে।’ খালু বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘মেয়ে খালি জামুইর দেকতি যাতি চাচ্চে। আমি বুজাচ্চি, তোমার যে পা ভাঙা ক্যাম কইরে নি যাব? মুবাইলে ফোন করতি চাচ্চে। আমি বুলচি, সেই ফোন পুলিশির কাচে আটকানো। অ্যাক্সিডেন্ট কইরেচ তুমরা, তাই পুলিশির কাচে রয়েচে। মেয়ে স্যাকন কানচে। আর কুনু কতা বলচে না, শুদু কানচে।’ ৯ বছর আগে স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় সোনিয়ার মা চম্পা খাতুনের। এরপর থেকে সদর উপজেলার তিতুদহ ইউনিয়নের বলদিয়া গ্রামের বিশ্বাসপাড়ায় ছোট ভাই খায়রুল ইসলামের বাড়িতে থাকেন। চম্পা খাতুন বলেন, ‘ছোট থেকেই খেয়ে না খেয়েই মেয়ে দুটোকে মানুষ করেছি। বিয়ে দিয়ে মনে করলাম যে ছাড় পাবন এট্টু। বিটার (শামীম) আমার কী এট্টা হয়ে গ্যালো।’
সদর হাসপাতালের সার্জারি (মহিলা) বিভাগে গিয়ে চিকিৎসাধীন শেফালি খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। তিন মাস বয়সী মেয়ে রজনীকে কোলে নিয়ে শয্যায় বসেছিলেন এই নারী। বৃহস্পতিার রাতের দুর্ঘটনার কথা মনে করতেই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন তিনি। শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা ইমাম আলী ও মা জোছনা খাতুন তাকে সান্ত¡না দেয়ার চেষ্টা করছেন।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শেফালি খাতুন বলেন, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শামীমের বাড়ির লোকজন সোনিয়াকে দেখতে আসেন। পরে দুই পক্ষের সম্মতিতে ওই দিনই দুজনের বিয়ে হয়। বিয়ের পর সোনিয়া শ্বশুরবাড়িতে যান। এলাকার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী, পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি আবার নববধূকে নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসেন শামীম। শুক্রবার সোনিয়াকে নিয়ে নিজ বাড়িতে ফেরার কথা ছিলো শামীমের। কিন্তু তার আগেই তো না ফেরার দেশে চলে গেলেন শামীম।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে সোনিয়ার এক আত্মীয়ের বাড়িতে তাদের দাওয়াত ছিলো। সেখানে যাওয়ার আগে মিষ্টি কিনতে সোনিয়া ও শেফালিকে নিয়ে শামীম মোটরসাইকেলে হিজলগাড়ি বাজারে যাচ্ছিলেন। কিন্তু বাজারে পৌঁছানোর আগেই কেরু কোম্পানির খামারের কাছে পৌঁছুলে একটি কুকুরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে তিনজনই মোটরসাইকেল থেকে রাস্তার ওপরে ছিটকে পড়েন। এতে ঘটনাস্থলে শামীম নিহত হন। স্থানীয় লোকজন তিনজনকেই উদ্ধার করে সদর হাসপাতালে নিলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমান শামীমকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে ছিলেন শামীম। শামীমের দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। অনেক অল্প বয়সে শামীম তার বাবা শফিউদ্দিনকে হারান। অনেক সংগ্রাম করে তার মা তিন সন্তানকে বড় করেছেন। শামীম হিজলগাড়ি বাজারে একটি বিস্কুট কারখানার কর্মচারী ছিলেন। এদিকে দুই বোনের মধ্যে সোনিয়া বড়। ছোট বোন ফাতেমা হিজলগাড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। সোনিয়া একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়েন। সোনিয়ার বাবার সঙ্গে তার মায়ের যোগাযোগ নেই। সোনিয়ার মা চম্পা খাতুন কৃষিকাজ করেন। অনেক সংগ্রাম করে দুই মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন তিনি। বাড়িতে কোনো পুরুষ সদস্য না থাকায় সোনিয়ার স্বামী শামীমকে ঘিরে ছিলো অনেক আশা-ভরসা। কিন্তু একটি দুর্ঘটনা দুটি পরিবারকেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিলো।
সোনিয়ার খালু বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমাদের পরিবারে আসলেই কারুরই তেমন ট্যাকা পয়সা নেই। ধার-দিনা করে পাঁচ হাজার ট্যাকা নিআইসে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যি দিইচি। অপারেশন করতি অনেক ট্যাকা লাগবে। গ্রামে ও হিজলগাড়ি বাজারে সাহায্য তুলার কতা থাকলিউ হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতি গিয়ে তা পারা যায়নি। কাল সকালতি সাহায্যর জন্যি ছুটতি হবে।’
সোনিয়ার মামা খাইরুল ইসলাম বলেন, সোনিয়ার চিকিৎসার জন্য ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকার প্রয়োজন। কিন্তু দুই পরিবারের কারও পক্ষেই এতো টাকা দেয়া সম্ভব নয়। এ জন্য রাজশাহীতে নেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থায় বলদিয়া গ্রাম ও হিজলগাড়ি বাজারের লোকজনের কাছ থেকে সাহায্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সোনিয়ার সু-চিকিৎসার জন্য সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা করার অনুরোধ করেছেন তিনি।