গাংনী প্রতিনিধি: নিজ হাতে রান্না করে তিনবেলা স্বামীকে খাওয়াতেন গৃহবধূ নিশাত তাসনীম উর্মি (২৪)। স্বামী না খেয়ে থাকবে তাই পিতার বাড়িতে গিয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারতেন না। এরপরেও চলতো উর্মির ওপর স্বামীর নির্যাতন। যে স্বামীকে সে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন সেই স্বামীর কাছেই নিরাপদ ছিলেন না উর্মি। শেষ পর্যন্ত স্বামীর হাতেই খুনের শিকার হতে হলো উর্মিকে। গতকাল শুক্রবার সকালে গাংনী থানা প্রাঙ্গণে উপরোক্ত কথাগুলো বলে বিলাপ করছিলেন নিহত উর্মির মা লায়লা আরজুমান বানু। মাসহ স্বজনদের বিলাপে উৎসুক মানুষও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনি। প্রেম প্রণয়ের করুণ পরিণতির হিসেব কষে উর্মির স্বামীর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে তার দৃষ্টান্তমূলক সাজা দাবি করেন অনেকে। হৃদয় বিদারক দৃশ্যের মধ্যে উর্মির পিতা গোলাম কিবরিয়া একপাশে নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলেন। নিহত নিশাত তাসনীম উর্মি গাংনীর চাঁদপুর গ্রামের (বর্তমানে বাঁশবাড়ীয়া) গোলাম কিবরিয়ার মেয়ে।
নিহতের পিতা জানান, বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে প্রিন্সের পিতা হাসেম শাহ তাকে মোবাইলে কল দিয়ে জানান যে উর্মি অসুস্থ তাই গাংনী হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এ খবর পেয়ে দ্রুত স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গাংনী হাসপাতালে যান গোলাম কিবরিয়া। তবে সেখানে গিয়ে উর্মির মরদেহ দেখতে পান। হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে জানান, বেশ আগেই উর্মির মৃত্যু হয়েছে। মরদেহ হাসপাতালে আনা হয়েছে। প্রিন্সের পিতা তাকে জানান, গলায় ফাঁস দিয়ে সে আত্মহত্যা করেছে। তবে মন মানেনি নিহতের স্বজনদের। প্রিন্সের সাম্প্রতিক কর্মকা- মনে আসতেই তারা আঁতকে ওঠেন। পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে তারা তাৎক্ষণিক চলে যায় প্রিন্সের বাসায়। যেখানে আত্মহত্যার কথা বলা হয়েছে সেই জায়গা পরিদর্শন করেন তারা। পরিদর্শনের সময় হত্যাকা-ের বিষয়টি তাদের কাছে স্পষ্ট হয়। জানালায় যেখানে আত্মহত্যার স্থান বলে প্রিন্সের পরিবার দাবি করছে সেখানে আত্মহত্যা করার মতো জায়গা নয়। ওড়না পেচিয়ে ঝুলে পড়লে তার পা নিশ্চিত মেঝেতে লেগে যাবে। আত্মহত্যার স্থান পর্যালোচনার পর তারা নিশ্চিত হয় তাকে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরে তারা আবারও হাসপাতালে লাশের পাশে ছুটে যান। এবার উর্মির শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান পরিবারের লোকজন। খবর পেয়ে রাতেই পুলিশ মরদেহ থানা হেফাজতে নেয়।
অভিযোগে জানা গেছে, কিছুদিন আগে প্রাইভেটকার কেনার জন্য শ^শুর পরিবার থেকে টাকা দেয়ার জন্য উর্মির ওপর চাপ দিচ্ছিলো প্রিন্স। স্বামীর সুখের জন্য প্রাইভেটকার কিনে দিতে রাজি হয় উর্মি। উর্মির নামে পিতার দেয়া এক বিঘা জমি ছিলো। ওই জমি বিক্রি করে গাড়ী কেনার সিদ্ধান্ত নেন গৃহবধূ উর্মি। সে লক্ষ্যে পিতার কাছ থেকে জমির দলিল নিয়ে এসে প্রিন্সের হাতে তুলে দিয়েছিলেন উর্মি। এরপরেও উর্মির সংসারে শান্তি ছিলো না।
জানা গেছে, প্রিন্স লেখাপাড়া করে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে অনার্সে। প্রিন্স ও উর্মির প্রেমের সম্পর্কের বিষয়টি মেনে নেয়নি উর্মির পরিবার। তবে মেয়ের সিদ্ধান্তের প্রতি এক পর্যায়ে মত দিতে বাধ্য হয় কিবরিয়া ও তার স্ত্রী চিৎলা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক লায়লা আরজুমান বানু। বছর চারেক আগে তাদের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে বেশ সুখেই কাটছিলো তাদের সংসার। তাদের সংসারে ১৩ মাস বয়সী একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান রয়েছে। এই সন্তান জন্মের পর থেকেই উর্মির ওপর স্বামীর নির্যাতন বাড়তে থাকে। স্ত্রী-সন্তানের প্রতি নজর ছিলো না। অদৃশ্য কোনো কিছুর মোহে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো প্রিন্স। এক পর্যায়ে বিষয়টি বড় আকার ধারণ করলে উর্মির পরিবারের নজরে আসে। তখন পরিবার থেকে উর্মিকে আর স্বামীর বাড়িতে যেতে দিতে রাজি হয়নি। কিন্তু হতাভাগা উর্মি ভেবেছিলো স্বামীকে সে আবারও সংসারে মনোযোগ ফেরাতে সক্ষম হবে। এমন আশায় পিতা-মাতাকে রাজি করে মাস দুয়েক আগে স্বামীকে নিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখতে থাকে। সুখের আশায় জমির দলিল তুলে দেয় প্রিন্সের হাতে।
জানা গেছে, হাসেম শাহ ও প্রিন্স গাংনী বাজারে আলাদা ব্যবসা করেন। পিতার রড সিমেন্টের ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি ট্রাক টার্মিনালের সামনে গাংনী হার্ডওয়ার অ্যান্ড স্যানিটারি নামে আলাদা দোকান দিয়েছে প্রিন্স।
উর্মির পরিবারের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার রাতে বাসায় গিয়ে স্ত্রীর ওপর চড়াও হয় প্রিন্স। এক পর্যায়ে তাকে বেধড়ক মারপিঠ করে। ছেলেকে নিবৃত করার পরিবর্তে প্রিন্সের মা উর্মিকে মারতে সহায়তা করেন। মারতে মারতে এক পর্যায়ে উর্মি মৃত্যুবরণ করেন। হত্যকা-ের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে গলায় ওড়না পেচিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এদিকে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে গাংনীর বিভিন্ন মহলের মানুষকে গাংনী থানা প্রাঙ্গনে হাজির করে প্রিন্সের পরিবার। হত্যাকা- ধামাচাপা দিয়ে আত্মহত্যা বলে চালাতে তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিলো না। বিশেষ করে প্রিন্সের নানা আমিরুল শাহ ঘটনাটি ধামাচাপা দিতে নিহতের পরিবারকে কোটি টাকার প্রস্তাব দেন। অবশ্য প্রস্তাব দিয়ে আমিরুল শাহ তিরস্কারের শিকার হয়েছেন। অপরদিকে উর্মির শিশুপুত্রকে তার নানির কাছে দিতেও বাধা দেয় আমিরুল শাহ। যদিও হাসেম শাহের ক’ভাই মিলে শিশুটিকে তার নানির কাছে পৌঁছে দেয়। আমিরুল শাহের এসব কর্মকা-ে হত্যাকা-ের পেছনে তার কোনো ইন্ধন আছে কি না তাও খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
গাংনী থানা সূত্রে জানা গেছে, নিহতের পিতার দায়ের করা মামলায় স্বামী প্রিন্স ও শ^শুর হাসেম শাহকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পালিয়ে গেছে প্রিন্সের মা। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা করছে পুলিশ। নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পরে গতকাল সন্ধ্যায় পিতার গ্রাম চাঁদপুরে জানাজা শেষে দাফন করা হয় উর্মির মরদেহ। তাকে শেষ বিদায় দিয়ে বিচারের দাবি জানায় ইবি লোকসাহিত্য বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীরা। প্রিয় সহপাঠীর এ করুণ পরিণতি তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
এদিকে মরদেরহ সুরতহাল রিপোর্ট তৈরী করেছেন এসআই শাহীন। তিনি জানান, নিহতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। যেখানে আত্মহত্যার কথা বলা হচ্ছে সেই স্থান এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন হত্যাকা-ের দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রাজ্জাক জানান, নিহতের পিতার দায়ের করা মামলায় প্রিন্স ও তার বাবা হাসেম শাহকে শনিবার সকালে মেহেরপুর আদালতে সোপর্দ করা হবে। মৃত্যুর সঠিক কারণ নির্ণয়ের জন্য ময়না তদন্ত প্রতিবেদন রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এদিকে ময়না তদন্ত প্রতিবেদন টাকা দিয়ে প্রভাবিত করা হবে এমন আলোচনা ছিলো গতকাল দিনজুড়ে। প্রিন্সের পরিবার বিত্তশালী। অপরদিকে প্রিন্সের নানার কোটি টাকার গরম। সব মিলিয়ে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রভাবিত করার বিষয়টি সব মহলেই আলোচনার বিষয়। তাই বিষয়টি নিয়ে মেহেরপুর জেলা স্বাস্থ্যবিভাগ, জেলা প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ঠ সকলের প্রতি সুবিচারের দাবি জানিয়েছেন কন্যার মৃত্যু শোকে কাতর গোলাম কিবরিয়া।