স্টাফ রিপোর্টার: ধেয়ে আসা করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ মোকাবেলায় সরকার আবারও সীমিত আকারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে যাচ্ছে। আগামী ৭ দিনের মধ্যেই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি হবে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এই বিধিনিষেধের আওতায় আবারও অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত আসছে। একইভাবে কমবে দোকানপাট-শপিংমল খোলা রাখার সময়সীমাও। টিকার সনদ ছাড়া রেস্তোরাঁয় খাবার খাওয়া যাবে না। প্রয়োজনে আবারও বন্ধ করা হতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। সবশ্রেণির মানুষকে মাস্ক পরতে বাধ্য করা হবে। শুধু তাই নয়, এখন থেকে কোয়ারেন্টাইনও হতে যাচ্ছে পুলিশের পাহারায়। সর্বোপরি সংক্রমণ বেড়ে গেলে সীমিত আকারের এই বিধিনিষেধ কঠোর বিধিনিষেধে রূপ দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বস্তি নিয়ে ২০২১ শেষ হলেও ২০২২ শুরু হয় পুরোপুরি অস্বস্তি নিয়ে। বছরের প্রথম দিন থেকেই করোনার সংক্রমণে উর্ধগতি বিরাজ করছে দেশজুড়ে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র মতে, মঙ্গলবার শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ৯১ শতাংশ। এর আগের দিন সোমবার শনাক্তের হার ছিল ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এর আগের দিন রবিবার অর্থাৎ ২ জানুয়ারি শনাক্তের হার ছিল পরীক্ষার বিপরীতে দুই দশমিক ৯১ শতাংশ। যা ১ জানুয়ারি ছিল দুই দশমিক ৪৩ শতাংশ। বছরের প্রথম দিন থেকে বাড়তে থাকা এ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণই এ বিধিনিষেধের প্রস্তুতি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জাহিদ মালেক নিজেই বলেছেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ মোকাবেলায় আসনের অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চলাচলের সিদ্ধান্ত আসছে। একই সঙ্গে কমছে দোকানপাট ও শপিংমল খোলা রাখার সময়। এ বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে আগামী সাতদিনের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে বলেও জানিয়েছেন মন্ত্রী।
মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে মন্ত্রী আরও জানান, আমরা এক সপ্তাহ ধরে লক্ষ্য করছি, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। যেভাবে বাড়ছে, এটা আশঙ্কাজনক। সেই চিন্তা-ভাবনা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। সেই বৈঠকে আমি ছিলাম, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, সচিবরা, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, এসপি, ডিআইজিরা যুক্ত ছিলেন। তাদের কিছু পরামর্শ ও নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেগুলো ফাইনাল না। ক্যাবিনেট থেকে ফাইনাল চিঠিটা যাবে সবার কাছে।
ওই বৈঠকের আলোচনার সূত্র ধরে তিনি বলেন, করোনাভাইরাস ও ওমিক্রনকে আমাদের রুখতে হবে। সেজন্য কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। যানবাহনে মাস্ক ছাড়া চলাচল করা যাবে না। যদি কেউ বাস, ট্রেন ও লঞ্চে চলাচল করে তাহলে জরিমানার মধ্যে পড়বে। এটার একটা সিদ্ধান্ত মোটামুটি হয়েছে। বাস ও অন্যান্য যানবাহনে যাত্রী সংখ্যা অর্ধেক পরিবহনের প্রস্তাব করা হয়েছে। রেস্টুরেন্ট ও হোটেলে মাস্ক পরে যেতে হবে। মাস্ক ছাড়া গেলে দোকানদারের জরিমানা হবে, যে যাবে তারও জরিমানা হতে পারে। এ সময় দোকান-মার্কেট খোলা রাখার সময়সীমা কমিয়ে আনা হবে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, রাত ১০টার পরিবর্তে রাত ৮টা পর্যন্ত দোকানপাট খোলা রাখা যাবে। এটাও প্রস্তাব করা হয়েছে।
তাই সবাইকে টিকা নেয়ার তাগিদ জানিয়ে মন্ত্রী বলেছেন, হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে হলে টিকা দেয়ার কার্ড দেখাতে হবে। অবশ্যই মাস্ক পরতে হবে। তবে এখনও স্কুল-কলেজ বন্ধ করার মতো অবস্থা হয়নি দাবি করে মন্ত্রী বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্কুল-কলেজ চলবে। যদি সংক্রমণ বেশি বৃদ্ধি পায় তাহলে স্কুল-কলেজের বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হবে। সংক্রমণ বেড়ে গেলে অবশ্যই স্কুল-কলেজ চালিয়ে রাখা যাবে না। এখনই সেই সিদ্ধান্ত না নেয়া হলেও পরিস্থিতি বিবেচনায় পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
লকডাউনের ব্যাপারে মন্ত্রী বলেন, পাশের দেশ লকডাউন দিয়েছে। আমরা এখনও সেই চিন্তা করছি না। যদি অবস্থা আওতার বাইরে যায়, সংক্রমণ অনেক বৃদ্ধি পায় তাহলে লকডাউনের চিন্তা মাথায় আছে। পাশাপাশি স্থল, নৌ ও সমুদ্রবন্দরে স্ক্রিনিং জোরদার করা হয়েছে। কোয়ারেন্টাইনের ক্ষেত্রে পুলিশ পাহারা বসানো হবে। এ বিষয়ে দৃষ্টি দিতে বলা হয়েছে।
করোনা মোকাবেলায় আগের মতোই হাসপাতালগুলো প্রস্তুত আছে জানিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য আমাদের ডিসি, এসপি যারা আছেন তারা ১৫ দিনের সময় চেয়েছেন। কিন্তু ১৫ দিন অনেক সময়। আমরা আজ (মঙ্গলবার) প্রস্তাব করেছি ১৫ দিন নয় এসব বিষয় বাস্তবায়ন করতে হবে ৭ দিনের মধ্যে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবও আমাদের সঙ্গে একমত রয়েছেন। কারণ ১৫ দিন অনেক লম্বা সময়। এর মধ্যে সংক্রমণ অনেক ছড়িয়ে যেতে পারে। আশা করি, সাতদিনই হবে। যেসব নির্দেশনা আছে, সেগুলো বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু হয়ে যাবে।
তবে দেশে এখনই লকডাউনের মতো অবস্থা তৈরি হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের মহাসচিব ডাঃ এম এ আজিজ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা দেখছি যে ওমিক্রন এখনও ওই রকমভাবে ছড়ায়নি। তাই লকডাউন দেয়ার দরকার পড়বে না। তারচেয়ে বরং বিমানবন্দরসহ সব বন্দরে স্ক্রিনিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা তা হলো, টিকা কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। কারণ, আমরা যতটুকু দেখছি যেসব দেশে ওমিক্রন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে সেসব দেশ টিকাদানের ক্ষেত্রে পিছিয়েছিল। তাই সবাইকে অবশ্যই টিকার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসক বলেন, আগামী ২ থেকে ৩ সপ্তাহ আমাদের একটা শঙ্কা রয়েছে। ওই সময়টায় কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। একই কথা বলেন অপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক আয়েশা আক্তার। তিনি বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে করোনায় ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৭৫ জনেরই অর্থাৎ প্রায় ৮২ দশমিক ৪ শতাংশের টিকা নেয়া ছিল না। তাই টিকাদান কর্মসূচির ওপর জোর দেয়ার বিকল্প নেই। সবাইকে টিকা নিতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসনকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, রাশিয়া, ইউরোপ, ভারতের মতো দেশে যে হারে ওমিক্রন ছড়িয়েছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ। আমাদের সৌভাগ্য যে, আমরা এখন পর্যন্ত ভাল অবস্থানে রয়েছি। আর এই ভাল অবস্থান ধরে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে টিকাদান কর্মসূচীর পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসনকেও কঠোর হতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, আমাদের বাঁচার একমাত্র উপায় সচেতনতা। এর কোন বিকল্প নেই। যদি স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা যায় তাহলে আশা করি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবে না।