স্টাফ রিপোর্টার: ব্যবসা-বাণিজ্যে আসবে ব্যাপক পরিবর্তন। বদলে যাবে চুয়াডাঙ্গার ব্যবসার চিত্র। অল্প সময়ে ও খরচে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে খুব সহজে যে কোন পণ্য আনা নেয়া দ্রুত সময়ে সম্ভব হবে। আর নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হলে মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মাঝে নবউদ্যোমে প্রাণ ফিরে আসবে। পিছিয়ে পড়া চুয়াডাঙ্গার উন্নয়নে দৃশ্যমান অবদান রাখবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে। অর্থনৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হবে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের এ জেলা চুয়াডাঙ্গা। স্থানীয়দের প্রত্যেশা পদ্মা সেতু ঘিরে চুয়াডাঙ্গায় গড়ে উঠবে নতুন নতুন শিল্প-কলকারখানা। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় ব্যবসায়ীরা নতুন কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ শুরু করছে।
চুয়াডাঙ্গার ব্যবসা-বাণিজ্য পিছিয়ে পড়ার মূল কারণ ছিলো যোগাযোগ ব্যবস্থা। চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পৌঁছুতে বিড়ম্বনার শেষ ছিলো না। কারণ প্রয়োজনীয় মালামাল আনা নেয়া করতে ভরসা করতে হয় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাটের ওপর। মালামাল পারাপারের জন্য দুই পারেই অপেক্ষা করতে হয় কয়েক ঘন্টা ও দিন। সেই ভোগান্তির দৃশ্যপট বদলে যাবে স্বপ্নের পদ্মা সেতু দিয়েই।
শিল্প কলকারখানা প্রয়োজনীয় উপকরণ আনতে হয় ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বেশ কয়েকটি জেলা থেকে। যোগাযোগ ব্যবস্থায় আছে বেহাল দশা। কারণ নির্দিষ্ট সময়ে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র না আসার কারণে কর্মকা- ব্যাহত হত। চুয়াডাঙ্গায় রয়েছে ছোট ও বড় শিল্প গড়ে ওঠার উপযুক্ত পরিবেশ। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা বলছেন পদ্মা সেতুর কারণে কয়েক বছরে বদলে যাবে এ এলাকা। পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দ্রুত সময়ে যোগাযোগ সম্পূর্ণ করা যাবে। ফেরিঘাটের অপেক্ষার অবসান হবে। উৎপাদিত মালামাল কয়েক ঘন্টায় দেশের নির্দিষ্ট স্থানে নেয়া যাবে। স্থানীয় ভাবে উৎপাদিত মালামালের চাহিদা কয়েক গুন বাড়বে।
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে থেকেই এ জেলার ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। ব্যবসায় ব্যাপক প্রসার ঘটার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসার বাজার সম্প্রসারণ হবে। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ছুটে আসবেন। এখানকার পরিবেশ ব্যবসা বান্ধব। সকল সুযোগ-সুবিধা বিদ্যামান রয়েছে।
নতুন করে সেতু ঘিরে আশার আলো জাগ্রত হয়েছে চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের মাঝে। বর্তমান সরকারের একটি মহৎ উদ্যোগ বলে জানান ব্যবসায়ীরা। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলে জেলার মানুষের কর্মসংস্থান হবে। আর দুর হবে বেকারত্ব। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। বর্তমান সরকার শিল্প বান্ধব সরকার।
পদ্মা সেতুর কারণে বিসিক শিল্পনগরীতে গড়ে উঠবে বড়, মাঝারি ও ছোট পরিসরে শিল্প কারখানা। শিল্প কারখানার মালামাল আনা নেওয়া সহজ হবে। বিসিক শিল্পনগরী ঘিরে জেলার উন্নয়ন সহজ হবে। বাংলাদেশ বদলে যাতে অর্থনৈতিক ভাবে। স্থানীয়দের আশা বিসিক সম্পর্ণ রুপে চালু করতে পারলে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে। পদ্মা সেতু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়ক হবে।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের পলাশপাড়ার নারী উদ্যোক্তা টগর খাতুন বলেন, ‘আমি হস্তশিল্পের কাজ করি। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অর্ডার পায়। যোগযোগ ব্যবস্থার কারণে সঠিক সময়ে পণ্য ডেলিভারি সম্ভব হয় না। অনেকে অর্ডার বাতিল করেন। পদ্মা সেতু দিয়ে পরিবহন চলাচল শুরু হলে এ ভোগান্তি লাগব হবে। ব্যবসার প্রসার ঘটবে।’
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের বেলগাছি গ্রামের মদিনা এলমুনিয়াম ফ্যাক্টারি মালিক মজিবুল হক বলেন, এলমুনিয়াম ফ্যাক্টারি কাঁচামাল আনতে হয় দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরিঘাট দিয়ে। ট্রাক পারাপার হতে ১-২ দিন পর্যন্ত সময় লাগতো। এর ফলে পণ্য উৎপাদনে ব্যাহত হত। নির্দিষ্ট সময়ে অর্ডার নেওয়া জিনিস সরবরাহ করা সম্ভব হত না। ফলে লোকসানের মধ্যে পড়তে হত অবিক্রিত জিনিষ নিয়ে। লোকসান দিয়েও বিক্রি করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অক্লান্ত পরিশ্রম করে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ করলেন। যা আমাদের জন্য ভাল কিছু হল। সেতু দিয়ে কাচামাল নিয়ে আসতে পারবো দ্রুত সময়ে। খরচ কম হবে একদিকে অন্যদিকে লাভ হবে। আর নির্ধারিত সময়ে মালামাল সরবরাহ করতে পারবো। ব্যবসার প্রসার ঘটবে।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার দশমাইল গ্রামের উদ্যোক্তা ফাতেমা খাতুন জানান, পড়াশুনার পাশাপাশি বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি করে থাকি। যার চাহিদা রয়েছে ঢাকাসহ বেশ কয়েকটি জেলায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক থাকায় অর্ডার নেয়া পণ্য ঠিক সময়ে যেতো না। ফলে লোকসান গুনতে হয়। পদ্মা সেতু নতুন করে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। এখন ব্যাপক পরিসরে কাজ করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি।
চুয়াডাঙ্গা জজ কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মো. আহসান আলী বলেন, ‘ঢাকাতে পেশার কাজ, চিকিৎসাসহ অন্য প্রয়োজনীয় কাজে নিয়মিত যাতায়াত করতে হয়। এক বুক হতাশা নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিতাম। কারণ, কোনো নিশ্চয়তা ছিল না কখন ঢাকা পৌঁছুবো। আর দিনের কাজ দিনে শেষ করা সম্ভব হবে কি ভাবে হবে। নানা হতাশা ছিল। এখন পদ্মা সেতু নতুন করে কর্মউদ্দীপনা বাড়িয়ে দিয়েছে। মামলাসংক্রান্ত বিষয়ে হাইকোর্ট ও দেশের অন্য আদালতে যাওয়া লাগে। আগে ইচ্ছা থাকলেও মন সাই দিত না। এখন মামলার কাজে আগ্রাহ নিয়েই সকালে যাবো আর কাজ সেরে রাতেই বাড়ি ফিরে পরিবারের সাথে থাকতে পারবো। ভালো লাগার জায়গা তৈরি হয়েছে পদ্মা সেতু ঘিরে।’
চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘ব্যক্তিগত কাজে পরিবহনে করে আমি আজ চুয়াডাঙ্গা থেকে ঢাকা যাচ্ছি। আগের মতোই ভয় কাজ করছে নির্দিষ্ট সময়ে ঢাকা পৌঁছুতে পারবো কিনা। ফেরিঘাটে কি অবস্থা হবে। কতো সময় ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকায় যেতে পারলে অল্প সময়ে পৌঁছে যাবো। আজকের যাওয়া পদ্মা সেতু দিয়ে যেতে পারলে অনেক ভাল লাগেত। এ জেলার মানুষ শিক্ষা ক্ষেত্রে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সামনের দিকে অগ্রগামী হচ্ছে। আমরা যখন ঢাকায় যেতাম তখন হাতে সময় ও দিন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হতাম। যাওয়া-আসা নির্ভর করতো রাস্তা ও ফেরিঘাটের ওপর। পারিবারিক ও কলেজের কাজে এক সময় নিয়মিত ঢাকামুখি হতে হতো। এখন বয়স হয়েছে, ইচ্ছা থাকলেই যেতে পারি না নানা সমস্যার কারণে। এখন সুন্দর পদ্মা সেতু হয়েছে। উদ্বোধনের পরে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে গাড়িতে চড়ে আয়েশ করে ঢাকা যেতে পারবো। মনের মধ্যে আর ভয় কাজ করবে না।’
জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি আফরোজা পারভীন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। পদ্মা সেতু চুয়াডাঙ্গার মানুষের জীবনমান বদলে দিয়েছে। দেশের জন্য প্রধানমন্ত্রী দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করছে। যা কারও পক্ষে কখনও সম্ভব হয়নি। উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ। রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কাজে আমরা ফেরি পার হয়ে ঢাকায় যেতাম। কখন পৌঁছুবো বলা কঠিন ছিল। পদ্মা সেতুর কারণে কয়েক ঘন্টায় ঢাকায় পৌঁছাতে পারবো। গাড়িতে চড়তে-চড়তে গল্প শেষ না হতেই ঢাকা আসবো। দেশের মানুষের স্বপ্ন পূরণ হল। ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করবেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রুপ নিয়েছে।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আজাদুল ইসলাম আজাদ বলেন, বাঙালি জাতির জন্য একটা অবিশ্বাস্য অর্জন। প্রধানমন্ত্রীর সততার কারণে সম্ভব হয়েছে। অনেক চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র হয়েছে পদ্মা সেতু নিয়ে। বিশ্ব ব্যাংক, জাইকা ও এশিয়ান ব্যাংক অর্থ সহায়তা বন্ধ করে দেয়। মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সারা বিশ্বে একটি আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সমস্ত চক্রান্ত প্রতিহত করে প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করেছেন। পদ্মা সেতু জিডিপিতে ভূমিকা রাখবে। আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ জেলার মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করছেন। যা বলে শেষ করা যাবে না। পদ্মা সেতু নির্মাণ করে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছা আছে আমার।
চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারের কাচামাল ব্যবসায়ী মাফিজুর রহমান বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সবজি, মরিচ, পেয়াজসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র আসে চুয়াডাঙ্গায়। অনেক সময় সড়কে ভোগান্তির কারণে নির্দিষ্ট সময়ে বাজারে মাল না আসায় অবিক্রিত থাকতো। ব্যবসায়ীদের লোকসান দিতে হত। এখন পদ্মা সেতু দিয়ে অল্প সময়ে বাজারে পন্য চলে আসবে। ক্রেতা ও বিক্রিতারা সঠিক দামে কেনা বেচা করতে পারবে।
চুয়াডাঙ্গা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইবরুল হাসান জোয়ার্দ্দার জানান, কোম্পানির মালামাল আসে ঢাকা, চট্রগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, গাজিপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে। ফেরিঘাটে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। সেতু চালু হলে ব্যবসায়ীরা তাদের প্রয়োজনীয় মালামাল পাবে। চাহিদা অনুসারে সরবরাহ সম্ভব হবে।
চুয়াডাঙ্গা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ইয়াকুব হোসেন মালিক বলেন, নানা জটিলতার কারণে ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে পড়তো। বিশেষ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল হওয়া দরকার। পদ্মা সেতু সেই আলো দেখাচ্ছে। দিনের কাজ দিনে শেষ করতে পারলে শুভ হবে। ব্যবসায় প্রাণ ফিরবে।