মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড নিয়ে মাঠে কর্মকর্তারা; প্রভাবশালীদের ছাড় নেই : সিআইডি
স্টাফ রিপোর্টার: চিত্রনায়িকা পরীমনি ও মডেল ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাইবাছাই করছে সিআইডি (অপরাধ তদন্ত বিভাগ)। তাদের সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ডও উদ্ধার হয়েছে। সিআইডি তাদের ফেসবুক, মেসেঞ্জার ও হোয়াটসআপ ডিজিটাল ফরেনসিক ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। তাদের মোবাইল ফোন থেকে প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তির অডিও রেকর্ড ও ভিডিও ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছে। এসব ভিডিও ফুটেজ ও অডিও রেকর্ড দিয়ে পরীমনি ও পিয়াসা প্রভাবশালীদের ব্ল্যাকমেইল করতেন।
সিআইডির সূত্র জানায়, গতকাল শনিবার রাতে পরীমনি, পিয়াসা, হেলেনা জাহাঙ্গীরসহ গ্রেফতার ছয়জনের বাসায় সিআইডি অভিযান চালিয়েছে। বারিধারায় পিয়াসার বাসায় অভিযান চালিয়ে তার ল্যাপটপ জব্দ করা হয়েছে।
এডিসি সাকলায়েন কান্ডে বিব্রত পুলিশ সাভারের বোট ক্লাবে ধর্ষণ চেষ্টার ঘটনায় দায়ের করা মামলার তদন্ত তদারকি কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের এডিসি গোলাম সাকলায়েনের সঙ্গে বাদিনী পরীমনির ঘনিষ্ঠতা, তার বাসায় দীর্ঘ সময় অবস্থানের ঘটনা ফাঁস হওয়ায় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছে পুলিশ। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে ডিবি থেকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) পশ্চিমে পদায়ন করা হয়েছে। এর আগে তাকে ডিবির সব দায়িত্ব থেকে নিবৃত্ত করা হয়। তবে এখনই তাকে প্রত্যাহার করা হয়নি। তাকে প্রত্যাহারের বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে অফিসিয়ালি সিদ্ধান্তের পর জানানো হবে বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন।
এসব বিষয় নিয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ ওমর ফারুক বলেন, ‘চিত্রনায়িকা পরীমনি, মডেল পিয়াসা ও আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেত্রী হেলেনা জাহাঙ্গীর ইস্যুতে দায়ের হওয়া মামলাগুলো সম্পূর্ণ প্রভাবমুক্তভাবে তদন্ত করা হবে। তদন্তে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নাম এলেও তাদের ছাড় দেয়া হবে না। জড়িত সবার বিরুদ্ধেই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে সিআইডি। শুক্রবার চিত্রনায়িকা পরীমনি, ব্যবসায়ী হেলেনা জাহাঙ্গীর, প্রযোজক রাজ, মডেল পিয়াসা ও মৌয়ের সাতটি মামলা আমাদের (সিআইডি) কাছে এসেছে। আসামিদের আমরা হেফাজতে পেয়েছি। ইতোমধ্যে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়েছে। এখনই বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনারা নিশ্চিত থাকতে পারেন, আইনের মধ্যে থেকেই মামলা তদন্ত করবে সিআইডি। সুষ্ঠুভাবে তদন্তকাজ সম্পন্ন হবে। যারা সত্যিকারভাবে দোষী, সিআইডি তাদের খুঁজে বের করবে।’ মালিবাগে সিআইডি কার্যালয়ে পরীমনি, পিয়াসা, হেলেনা জাহাঙ্গীরসহ প্রত্যেককেই পৃথক কক্ষে রাখা হয়েছে। গতকাল তাদের পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে সিআইডি।
মডেল পিয়াসার সঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম মোকাম্মেল হক চৌধুরীর মোবাইল ফোনে কথোপকথনের অডিও রেকর্ড উদ্ধার হয়েছে। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইনসিওরেন্সের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের সঙ্গে মডেল মরিয়ম আক্তার মৌয়ের গোপন ভিডিও রয়েছে। পিয়াসার সঙ্গে ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থপনা পরিচালক চুয়াডাঙ্গা সন্তান দিলীপ কুমার আগরওয়ালের বেশ কয়েকটি অডিও রেকর্ড পেয়েছে সিআইডি। একটি অডিও রেকর্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে সিআইডি কর্মকর্তা বলেন, পিয়াসাকে ডায়মন্ডের অলংকার উপহার দেয়ার কথা বলেছেন দিলীপ কুমার আগরওয়াল। একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফীনের সঙ্গে পরীমনির অডিও রেকর্ডে একটি গাড়ি উপহার দেয়ার কথা রয়েছে। একই সঙ্গে ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান শওকত রুবেলের সঙ্গে পরীমনির গভীর সখ্যের বিষয়টি কথোপকথনে উঠে এসেছে। বাংলাদেশে একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান রাকিবুল ইসলামের সঙ্গে পরীমনির মোবাইল ফোনে কথা হতো।
অন্যদিকে ভারতীয় ব্যবসায়ী প্রেমস বাওয়ানীর সঙ্গে পিয়াসার একটি ক্লাবে সময় কাটানোর ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। গুলশানে একটি দামি ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রির শোরুমের মালিক ইবনুল হাসান খোকনের সঙ্গে পরীমনি ও পিয়াসার বহুবার কথোপকথন হয়েছে মোবাইল ফোনে। মদ বিক্রির দোকানের মালিক রানা শফিউল্লাহর সঙ্গে পিয়াসার লংড্রাইভে যাওয়ার কথোপকথন রয়েছে। বাংলাদেশে গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিটার সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের সহসভাপতি হাবিবুল্লাহ ডনের সঙ্গে পিয়াসার হোয়াটসআপে বেশ কয়েকবার কথোপকথন হয়েছে। হাবিবুল্লাহ ডনের মালিকানাধীন গুলশানের গাড়ির শোরুম অটো মিউজিয়ামে চোরাই গাড়ি বিক্রি হয়। মডেল পিয়াসা ওই চোরাই গাড়ি সিন্ডিকেটের সদস্য। অটো মিউজিয়াম থেকে পিয়াসার সহযোগী মিশুর চুরি করা একটি গাড়ি উদ্ধার করেছে র্যাব।
সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারকৃতদের মোবাইল ফোন ও ফেসবুক আইডি তল্লাশি করে প্রভাবশালী ২১ ব্যক্তির সঙ্গে পিয়াসা, পরীমনি ও মৌয়ের যোগাযোগ থাকার তথ্য মিলেছে। এর বাইরে পিয়াসার মোবাইল ফোনের কললিস্টে বেশ কয়েক জন ব্যবসায়ীর মোবাইল নম্বর পাওয়া গেছে। ওইসব ব্যবসায়ীকে পিয়াসা ফোন করে ব্ল্যাকমেইলিং করতেন।
অন্যদিকে গতকাল সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি ওমর ফারুক বলেন, ‘কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তা হোক বা যে কেউ হোক। আমরা চাই নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করতে। তারা যত ক্ষমতাধরই হোক না কেন, আইনের আওতায় আসতে হবেই।’ পরীমনির সঙ্গে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) গোলাম সাকলায়েনের অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আমরা সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করবো। সে কারণে মামলাসংক্রান্ত এবং আসামিসংক্রান্ত বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যম ও গণমাধ্যমে যা প্রকাশ পাবে, সে বিষয়গুলো তদন্তে আসামি ও সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’
বনানী থানার মাদক মামলায় পরীমনির কস্টিউম ডিজাইনার জুনায়েদ করিম জিমির তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাসুদ-উর-রহমান রিমান্ডের এ আদেশ দেন। এর আগে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান জোনাল টিমের পরিদর্শক মো. আব্দুস ছোবাহান জিমিকে আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।