স্টাফ রিপোর্টার: পৌষের মাঝামাঝিতে হঠ্যাৎ করেই চুয়াডাঙ্গায় জেঁকে বসেছে শীত। মেঘলা কেটে যাওয়ায় গত বুধবার দুপুরের পর থেকে তাপমাত্রা করতে থাকে। একদিনের ব্যবধানে চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা কমেছে ৬ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গতকাল বৃহস্পতিবার জেলায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। যা এ বছরের মধ্যে জেলায় সর্বনিম্ন। একদিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা এতোটা কমে যাওয়া বেশ অস্বাভাবিক বলে জানিয়েছেন আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। এর আগে গত বুধবার জেলায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিলো ১৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাংলা দিনপঞ্জি অনুযায়ী আজ শুক্রবার পৌষ মাসের ১৫ তারিখ। মাঘ মাস আসতে এখনো ১৫ দিন বাকি। সাধারণত মাঘ মাসে শীতের তীব্রতা বাড়ে। কিন্তু মধ্য পৌষেই হঠাৎ করে তাপমাত্রা এতো কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মানুষ। উত্তরের হিমেল হাওয়ায় থরথর কাঁপছে প্রকৃতি ও জনজীবন। ঠা-ার প্রকোপ বাড়তে থাকায় লোকজন সন্ধ্যার আগেই ঘরে ফিরেছে।
অনেকেই লেপমুড়ি দিয়ে শীত নিবারণের চেষ্টা করেছেন। শীতের তীব্রতা থেকে দরিদ্র মানুষকে রক্ষায় বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আমিনুল ইসলাম খান বলেন, সরকারি উদ্যোগ জেলায় এ পর্যন্ত ২১ হাজার ১০০টি কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ৩০ হাজার কম্বলের চাহিদা জানিয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও শীতবস্ত্র বিতরণ শুরু হয়েছে।
চুয়াডাঙ্গার হাটকালুগঞ্জে অবস্থিত প্রথম শ্রেণির আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রকিবুল হাসান বলেন, চলতি মরসুমে এটিই সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। তিনি বলেন, ‘আমার ১৮ বছরের চাকরি জীবনে এক দিনের ব্যবধানে তাপমাত্রা এতো কমে যাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম।’ আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, চলতি মরসুমে এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ছিলো ওইদিন সারা দেশেরও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা। এরপর ১৮ ডিসেম্বর থেকে গতকাল ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ দিনে জেলার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১০ দশমিক ৫ ডিগ্রি থেকে ১৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করছিল। হঠাৎ করেই আজ তাপমাত্রা এত নিচে নেমে যায়।
তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পাশাপাশি উত্তর থেকে আসা হিমেল হাওয়ায় চুয়াডাঙ্গায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অনেকটাই ব্যাহত হচ্ছে। নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষেরা পড়েছেন বিপাকে।
অন্যদিকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাষে বলা হয়েছে, এ সময়ে চুয়াডাঙ্গা ও রাজশাহীসহ আশপাশের জেলাগুলোতে দিন ও রাতের তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। কনকনে ঠা-া বেশি অনুভূত হবে। এমনকি চলমান শৈত্যপ্রবাহ মাঝারি ও তীব্র শৈত্যপ্রবাহেও রূপ নিতে পারে দুদিনের ব্যবধানে। চলমান শৈত্যপ্রবাহ ৫ থেকে সাতদিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলেও আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। বিশেষ করে উত্তর ভারত ও গাঙ্গেয় অববাহিকায় বাতাসে হালকা তুষারপাত হচ্ছে। এই হাওয়া রাজশাহী অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে ঢুকছে। এ কারণে দ্রুত তাপমাত্রা কমছে।
এদিকে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের জরুরি সতর্কীকরণ বুলেটিনে বলা হয়েছে- চুয়াডাঙ্গা ছাড়াও রাজশাহী নওগাঁ, পাবনা ও নীলফামারী জেলার ওপর দিয়ে মৃদু শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। পরবর্তী সময়ে উত্তরের আরও কয়েকটি জেলায় বিস্তার লাভ করতে পারে। ঘন কুয়াশার কারণে সড়ক মহাসড়কে যানবাহন চলাচল ব্যাহত হতে পারে। রাতের বেলা নদী অববাহিকায় ঘন কুয়াশায় ঢেকে দৃষ্টিসীমা ১০০ মিটার থাকতে পারে।
আবহাওয়া অফিসসূত্রে জানা গেছে, দ্রুত সময়ে বাতাসে তাপমাত্রার পরিমাণ অধিক কমে কনকনে ঠা-া অনুভূত হলে এ পরিস্থিতিকে শৈত্যপ্রবাহ বলে। তাপমাত্রা ৮ থেকে ১০ ডিগ্রি হলে মৃদু, ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি হলে মাঝারি ও ৬ থেকে ৪ ডিগ্রি হলে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ এবং ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে তাকে অতি তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বলে।
চুয়াডাঙ্গায় গতকাল বৃহম্পতিবার জেলায় সকাল ৯টায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ৮ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে। সেইসাথে বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৪ শতাংশ। মৃদু শৈতপ্রবাহের প্রভাবে চুয়াডাঙ্গায় বেশি শীত অনুভূত হচ্ছে। ভোরে ঘন কুয়াশা আর প্রচ–শীতে নাজেহাল এ জেলার মানুষ। নিতান্তই প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হওয়াটা বেশ কষ্টের। এমন শীতের মধ্যেও ভোর থেকে অনায়াসে মাটি আর পানি দিয়ে ইটভাটায় কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন শত শত শ্রমিক।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কুয়াশার মধ্যে স্তূপ থেকে মাটি নিচ্ছেন বেশ কিছু শ্রমিক। সেখান থেকে মাটি ট্রলিতে করে মিশ্রন মেশিনে দিয়ে ইট তৈরি উপযোগী করে ইট বানানোর লাইনে দিচ্ছেন কেউ কেউ। সেই মিশ্রন মাটি দিয়ে ইট বানিয়ে যাচ্ছেন আরও কিছু শ্রমিক। এভাবেই শীতের সকালে ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা গেছে ইটভাটা শ্রমিকদের।
শ্রমিকেরা জানান, প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় ইটভাটায়। তবে, বৃহস্পতিবার হঠাৎ করে তাপমাত্রা কমে যাওয়ায় প্রচ- শীত আর কুয়াশার কারণে একটু দেরিতেই কাজ শুরু করতে হয়েছে।
ইটভাটা শ্রমিক মনোয়ার হোসেন জানান, ইট তৈরি করার জন্য শ্রমিক হিসেবে কাজ করছি, শীত হোক, আর যাই হোক! আমাদের সকলেরই ভোরে উঠতে হয়। না হলে হাজরে হবে না। তবে, শীত ও কুয়াশার দিনে একটু দেরিতে কাজ শুরু করি। আর কাজ শুরু করলে কাজের ব্যস্ততায় শীত-কুয়াশার কথা মনেই থাকে না।
শ্রমিক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা অন্যদিনে অন্তত ১৬ হাজার ইট তৈরি করি। কিন্তু এ শীতের দিনে ১০ হাজারের বেশি করতে পারছি না। এতে আমাদের হাজিরা কম হচ্ছে।
মহিলা শ্রমিক মরিয়ম বেগম জানান, আমরা ভোর থেকেই মাটির স্তূপ থেকে মাটি কেটে ট্রলিতে ভরে মেশিনে দেয়া শুরু করি। শুরুতে শরীরে শীতবস্ত্র থাকলেও পরে গরমে অতিষ্ঠ হয়ে খুলে রাখি। কাজ শুরু করার সময় কিছুটা শীত লাগলেও কাজ শুরুর পরে শীত পালিয়ে যায়।
এদিকে, চুয়াডাঙ্গায় তারাদেবী ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সুবিধাবঞ্চিত তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মধ্যে শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেল চারটায় চুয়াডাঙ্গা পান্না সিনেমা হল প্রাঙ্গনে চাঁদের আলো সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি নামে চুয়াডাঙ্গার হিজরা ও লঙ্গিক বৈচিত্রময় জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রায় দেড় শতাধিক কম্বল বিতরণ করা হয়। শীতবস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে শীতার্ত তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর মাঝে শীতবস্ত্র তুলে দেন সিঙ্গাপুরস্থ বাংলাদেশ বিজনেস অব চেম্বারের (বিডিচেম) প্রেসিডেন্ট, সাহিদ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলহাজ সাহিদুজ্জামান টরিক।
এ সময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার সাবেক মেয়র ও জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক ওবাইদুর রহমান চৌধুরী জিপু, বাংলাদেশ সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিটের সভাপতি ও দৈনিক সময়ের সমীকরণ এর প্রধান সম্পাদক নাজমুল হক স্বপন, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্মআহ্বায়ক মতিয়ার রহমান মতি, তারাদেবী ফাউন্ডেশনের নির্বাহী কর্মকর্তা আলমগীর কবির শিপলু, দৈনিক সময়ের সমীকরণ’র বার্তা সম্পাদক হুসাইন মালিক, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ সদস্য স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা ফরিদ আহমেদ, চাঁদের আলো সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটির সভাপতি শামসুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক স্বপন হিজরা প্রমুখ।
মেহেরপুর অফিস জানিয়েছে, ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে অর্ধেক তাপমাত্রা কমে গিয়ে মেহেরপুরে বেড়েছে শীতের তীব্রতা। কনকনে ঠা-ায় বিপর্যস্ত জনজীবন। বুধবার সন্ধ্যার পর থেকেই ঠা-া শুরু হয়েছে। যার ফলে রাত ৮টার পর থেকেই সড়কে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল কমে যায়।
সকালে অধিকাংশ সময় সড়কগুলো ছিল ফাঁকা। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে কেউ বের হয়নি। তবে কনকনে ঠা-াকে উপেক্ষা করে কাজের সন্ধানে ছুটতে দেখা গেছে নিম্ন আয়ের মানুষদের। হালকা কুয়াশার সাথে মৃদু বাতাস থাকায় শীত বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। নিম্ন আয়ের মানুষ অনেকেই শীত ঠেকাতে পলিথিন ব্যবহার করছে।
ভ্যান চালক টিটু জানান, গত দুদিন ধরে শীত কম ছিল। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যার পর থেকে ঠা-া শুরু হয়েছে। সকালে ভ্যান নিয়ে বের হয়েছি। ভান চালানোর সময় হাত-পা ঠা-া হয়ে যাচ্ছে; এতে খুব কষ্ট হচ্ছে। ঠান্ডায় কষ্ট হলেও কিছু করার নেই। পরিবারের সদস্যদের খাবারের চিন্তা করে বের হয়েছি। বসে থাকলে খাবো কি? গরিব মানুষ।
চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা রাকিবুল ইসলাম জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় এ অঞ্চলে সর্ব নিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৮ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গতকাল রেকর্ড করা হয়েছিল ১৫ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে তাপমাত্রা অর্ধেক কমে মৃদু শৈত প্রবাহ শুরু হয়েছে। যা থাকবে আরো কয়েকদিন। তবে ১ জানুয়ারি এ অঞ্চলে হালকা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে।