দীর্ঘ ২৬ বছরেও বুঝে পাইনি সরকারি জমি

মুজিবনগর সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানকারী ৯ আনসারের আক্ষেপ

মহাসিন আলী:

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার (বর্তমান মুজিবনগর) আম্রকাননে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ নেয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’। প্রথম সরকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানন্ত্রী হন। এছাড়া ওই সরকারের মন্ত্রিসভার অন্যান্যরা ছিলেন অর্থমন্ত্রী হিসেবে ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এএইচএম কামারুজ্জামান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে খোন্দকার মুশতাক। ওই সময় এমএজি ওসমানীকে বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়।

পরবর্তীতে বৈদ্যনাথতলার নাম পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে মুজিবনগর রাখা হয়। তৎকালীন এসপি মাহবুব উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে প্রথম বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিবনগর সরকার’কে গার্ড অব অনার প্রদানে পুলিশ ও আনসার সমন্বয়ে গঠিত একটি দল অংশ নিয়েছিল। আনসারদের ১২ জন ও পুলিশের ৫ জনসহ মোট ১৭ জন গার্ড অব অনারে অংশ নিয়েছিল। ১২ জন আনসার সদস্য সবাই মুজিবনগর উপজেলার বাসিন্দা ছিলেন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে প্রত্যেক আনসার সদস্যকে মেহেরপুরের বিভিন্ন স্থানে সরকারি খাস জমি বন্দোবস্ত দেয়। সে সময় মেহেরপুর শহরের পুলিশ লাইন সংলগ্ন খড়ের মাঠ, সদর উপজেলার গুচ্ছগ্রামে ও পুলিশ লাইনপাড়া, সিংহাটি ও ময়ামারী গ্রামের সরকারি খাস জমি ওই ১২ জন আনসার সদস্যদের প্রত্যেকে বরাদ্দ দেয়। কাউকে ৫২ শতাংশ, কাউকে ৩০ শতাংশ আবার কাউকে ৫৩ শতাংশ- এভাবে জমির ধরণ অনুযায়ী তাদের নামে জমি বন্দোবস্ত দেয় সরকার। সে সময় থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র ৩ জন আনসার সদস্য সরকারি জমি বুঝে পেয়েছে। বাকি ৯ জন আনসার সদস্য বিভিন্ন জটিলতার কারণে আজ পর্যন্ত সরকারের বরাদ্দ দেয়া জমি বুঝে পায়নি। অনেকেই জমি ফেরত পেতে মামলা চালাতে গিয়েও খুইয়েছে হাজার হাজার টাকা।

জমি না পাওয়া ৯ আনসার সদস্যের মধ্যে আজিমুদ্দিন শেখ, সিরাজ উদ্দিন শেখ ও হামিদুল হক আজও জীবিত আছেন। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে ওই তিনজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাদের মুখে শোনা যায় এই হতাশার কথা।

আনসার সদস্য সিরাজ উদ্দিন শেখ বলেন, তৎকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসে প্রথম সরকারকে গার্ড অব অনার প্রদানে অংশ নিই। দেশ স্বাধীনের পর আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের জমি বরাদ্দ দেয়। আজ পর্যন্ত বুঝে পাইনি। পুলিশ লাইনপাড়ায় আমার বরাদ্দের ৫০ শতাংশ জমিতে প্রভাবশালী একজন বসবাস করছেন।

জীবিত এই বীরদের জীবনজীবিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে গর্বিত গার্ড অব অনার প্রদানকারী আজিমুদ্দিন শেখ বলেন, তখন করেছি স্বাধীনতাযুদ্ধ আর এখন করছি জীবনযুদ্ধ। শরীরে তেমন শক্তি নেই। জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এই যুদ্ধ চালাতেই হবে। বর্তমান সরকার আমাদের যথেষ্ট ভাতা দিচ্ছে। তবে সরকারের দেয়া ঘরটাতে বাস করা যাচ্ছে না। বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি পড়ে। এছাড়াও সরকার ভূমিহীন হিসেবে আমাকে ৯৬ সালে সদর উপজেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রামে ৫৩ শতাংশ খাস জমির দলিল দিয়েছে। কিন্তু সেই জমির দখল এখনো পাইনি। দখলদার ফুলবাস নামের একজন প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে মামলা-পাল্টা মামলা চালাতে গিয়ে এখন আমি নিঃস্ব। স্থানীয় প্রশাসন ডামি দিলো। কিন্তু জমির দখল বুঝিয়ে না দিয়ে অবহেলা করেছে। এটা খুবই কষ্টের, আর কারো কাছে অভিযোগ করার ইচ্ছা হয় না।

সরকারের কাছ থেকে খাস জমি পেয়েও বন্দোবস্ত পাননি আনসার সদস্য মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হকও। তিনি জানান, চাষাবাদ করেই খাই। ১৯৯৬ সালে সরকার আমাকে খাস জমি দিলেও জমির বন্দোবস্ত পাইনি। অন্যের দখলি জমি আমাকে দেয়ার কি দরকার ছিল?

জীবিত তিনজনের মুখ থেকেই শোনা যায়, জমি বন্দোবস্ত পাইনি আরও ৬ জন আনসার সদস্য। এদের মধ্যে রয়েছে মফিজ উদ্দিন, ইয়াদ আলী মল্লিক, নজরুল ইসলাম, মহিউদ্দিন ও ফকির মোহাম্মদ। তবে আনসার সদস্য কেসমত আলী, সাহেব আলী ও লিয়াকত আলী এই তিনজন আনসার সদস্য সরকারের দেয়া জমি সঠিকভাবে বুঝে পেয়েছেন।

জানতে চাইলে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজন সরকার বলেন, আনসার সদস্যদের সাথে কথা বলে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Comments (0)
Add Comment