দর্শনা অফিস: মহামারী নোভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে দর্শনাবাসী চরম অনিশ্চয়তার প্রহর গুনছে। সারাদেশের মতোই দর্শনায় দিনদিন করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এরই মধ্যে করোনা উপসর্গ নিয়ে দর্শনায় একজনের মৃত্যু হয়েছে। করোনা শনাক্তের সংখ্যা ২৩ জন। দর্শনা পৌরসভার ৫ ও ৭নং ওয়ার্ড রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে লকডাউন করা হয়েছে। এসব দুঃসংবাদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে দর্শনা থানায় করোনা আক্রান্ত ১৭ জনের মধ্যে ১৫ জনের সুস্থতা।
করোনাকে জয় করে হাসপাতাল থেকে ফিরে থানার দায়িত্ব বুঝে নিয়ে নব উদ্দীপনায় কাজে নেমেছেন দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান। এলাকার অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছেন, দর্শনার লকডাউন এলাকার ৭টি স্থানে পুলিশি চৌকির ব্যবস্থা থাকলেও কঠোর আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যাচ্ছে না। ফলে মানছে না কেউ লকডাউন। যে কারণে দর্শনায় করোনা ভয়াবহ আকার ধারনের আশঙ্কা রয়েছে বলে ধারণা সচেতন মহলের। তাছাড়া দর্শনা বাসস্ট্যান্ড এলাকার এক মসজিদের ইমামসহ একই পরিবারের ৩ জনের আক্রান্ত হওয়ার খবর এবং ওই পরিবারের একজনের মৃত্যুতে এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। যদিও বাড়তি সতর্কতায় ঘাটতির বিষয়টি ঘুরে ফিরেই চোখে পড়ছে। তাছাড়া দর্শনার বাসস্ট্যান্ড এলাকাটি লাল এলাকাভুক্ত করা হয়নি এখনও।
গত ২৬ মে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হন দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান কাজল। একই দিন করোনা টেস্টে পজেটিভ রিপোর্ট আসে দর্শনা মোহাম্মদপুরের রুবেলের। দু’দিন পর দর্শনা থানার কনস্টেবল নারায়ণের করোনা পজেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। ওসিসহ দুজন করোনা আক্রান্তের পর দর্শনা থানার প্রায় অর্ধশত সদস্যের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। এদের মধ্যে ২য় দফায় ৬ পুলিশ সদস্যের করোনা ভাইরাস পজেটিভ রিপোর্ট আসে। আক্রান্ত ওই ৬ জনের মধ্যে ছিলেন থানার সেকেন্ড অফিসার এসআই জাকির হোসেন, এসআই শরিফুল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, মাহমুদুল হক, পিএসআই সোয়াদ ও কনস্টেবল আলাউদ্দিন। প্রত্যেককেই চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। ৩য় দফায় আরও ৬ পুলিশ সদস্যসহ থানার কাজের বুয়ার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট এসেছে। ৬ পুলিশের মধ্যে ছিলেন দর্শনা থানার ভারপ্রাপ্ত ইনচার্জ, ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শেখ মাহবুবুর রহমান, এএসআই মারুফ হাসান, সাইদুর রহমান, মহিউদ্দিন, কনস্টেবল ফরহাদ ও মিজান। থানার কাজের বুয়া পারুলও করোনায় আক্রান্ত হন একই সাথে। করোনা আক্রান্তদের চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। ৪র্থ দফায় দর্শনা থানার কনস্টেবল হুমায়ুন ও মামুন করোনায় আক্রান্ত হয়ে সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এরই মধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন থানার কাজের বুয়া দর্শনা রিফুজি কলোনিপাড়ার পারুলের মেয়ে পপি ও নাতনি ৪ বছরের শিশু সুস্মিতা। এদিকে দর্শনা বাসস্ট্যান্ড এলাকার দিলরুবা নামের এক নারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও শেষঅবধি তার হদিস মেলেনি। এছাড়া করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যান দর্শনা বাসস্ট্যান্ডের সোলায়মান হক (৫৮)। সোলায়মানের পরিবারের সদস্যদের নমুনা পরীক্ষা করা হলে স্ত্রী বিলকিছ ও ছেলে কেরুজ নিরাপত্তা কর্মী জসিমের পজেটিভ রিপোর্ট আসে। সেই সাথে দর্শনা বাসস্ট্যান্ড জামে মসজিদের পেশ ইমাম উসমান গনির নমুনা পরীক্ষায়ও পজেটিভ রিপোর্ট পাওয়া যায়। ফলে দর্শনা বাসস্ট্যান্ড এলাকাতেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫ জন। ওয়ার্ডভিত্তিক ২নং ওয়ার্ডের বাসস্ট্যান্ড ও মোহাম্মদপুরে করোনা রোগীর সংখ্যা ৬ জন। দর্শনা থানার অফিসার ইনচার্জ মাহবুবুর রহমান কাজল করোনাজয়ী হয়ে ঝিনাইদহ হাসপাতাল থেকে ফিরে ১৪ দিন ছিলেন হোম কোয়ারেনটাইনে। গতকাল শুক্রবার ১৪ দিনের হোম কোয়ারাইনটাইন শেষে থানার চার্জ বুঝে নিয়েছেন। এছাড়া দর্শনা থানার আক্রান্ত ওসিসহ (তদন্ত) ১২ জনের নেগেটিভ রিপোর্ট এসেছে গত বুধবার রাতে। ফলে দর্শনা থানার আক্রান্ত ১৫ জনের মধ্যে ১৩ পুলিশ সদস্য সুস্থ হয়েছেন। এলাকাবাসীর অভিযোগে জানা গেছে, পৌর শহরের মধ্যে দর্শনা বাসস্ট্যান্ডের বর্তমান পরিস্থিতি ভয়াবহ। অথচ লকডাউনমুক্ত বাসস্ট্যান্ডবাসী চরম ঝুঁকিতে। এদিকে দর্শনা পৌরসভার ৫ ও ৭নং ওয়ার্ডকে রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে গত বুধবার লকডাউন ঘোষণা দেন চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার। ঘোষণা অনুযায়ী বৃহস্পতিবার লকডাউন কার্যকর শুরু হয়। লকডাউনের আওতাভুক্ত দুটি ওয়ার্ডের মধ্যে রয়েছে রিফুজি কলোনি ও থানাপাড়া। লকডাউন ও সরকারের নির্দেশ মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শসহ নেয়া হয়েছে পুলিশি চৌকির ব্যবস্থা। দুটি ওয়ার্ডের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে লকডাউনের ব্যানার, বাঁশের ব্যারিকেড ও চিহ্নিত ম্যাপ টানানো হয়েছে। ৭টি পয়েন্টে পুলিশি চৌকির ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও তা চোখে পড়েনি অনেকেরই। হাতেগোনা ২-১টি পয়েন্টে পুলিশের উপস্থিতি দেখা গেলেও তা ছিলো নীরব দর্শকের ভূমিকায়। দর্শনা রেলগেট পয়েন্টে ব্যানার ও ম্যাপ ঝুলালেও পুলিশকে কোনো ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। পুলিশি কঠোরতা না থাকায় লকডাউন মানার ধার ধারছে না কেউ। সূত্র থেকে জানা গেছে, ৫ ও ৭নং ওয়ার্ডের ভোটার সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৬ হাজার হলেও জনসংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। লকডাউন ঘোষিত দুটি ওয়ার্ডে দুস্থ ও কর্মহীনদের সংখ্যাই সিংহভাগ। যে কারণে জীবিকার সন্ধানে বাড়ি থেকে বের হতে হচ্ছে। লকডাউন এলাকায় কোনোপ্রকার সরকারি-বেসরকারিভাবে ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়নি এখনও। দর্শনা পুরাতন বাজার দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম সোহেল, সদস্য আনোয়ার হোসেন, ব্যবসায়ী কার্তিক সাহাসহ বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক লকডাউন মানছি। দীর্ঘদিন লকডাউনের কারণে মানবেতন জীবনযাপন করেছি। আমরা লকডাউন আওতার বাইরে থাকা সত্ত্বেও লকডাউন পালন করছি। ছোট-খাটো ব্যবসায়ীরা সরকারি সহায়তা পেলে খেয়ে পরে বাঁচার সুযোগ পাবে। বিশিষ্ট ওষুধ ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, সরকার লকডাউন ঘোষণা দেয় আমাদের সুবিধার জন্য। অথচ আমরা নিজের ভালো বুঝি না। তাই সরকারের নির্দেশনাও মেনে চলি না। আমাদের উচিত নিজেদের ভালোর জন্য সরকারের সকল নিয়ম কানুন মেনে চলা। দর্শনা থানার ওসি মাহবুবুর রহমান বলেন, লকডাউন এলাকায় ৭টি পয়েন্টে পুলিশ প্রহরার ব্যবস্থা রয়েছে। শনিবার থেকে আরও কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করা হবে লকডাউন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে। দর্শনা পৌরসভায় লকডাউন নিয়ন্ত্রণ, ত্রাণ সহায়তা বিতরণ, করোনা প্রতিরোধ বিষয়ক ওয়ার্ড ভিত্তিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে আজ শনিবার বেলা ১১টার দিকে দর্শনা পৌরসভার হলরুমে। লকডাউন ঘোষিত ওয়ার্ডসমূহে করণীয় ও কঠোরতাসহ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের ব্যাপারে ওই বৈঠকে আলোচনা হবে বলে জানিয়ে পৌর মেয়র মতিয়ার রহমান বলেন, লকডাউন সফল করতে সরকারের সকল নির্দেশনা মানা হবে। সেক্ষেত্রে গ্রহণ করা হবে কঠোর ব্যবস্থা। দর্শনাকে করোনামুক্ত করতে সব ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হবে। চুয়াডাঙ্গা জেলা পরিষদের সাবেক প্রশাসক মাহফুজুর রহমান মঞ্জু বলেন, দর্শনায় অসচেতনতার অভাবে ভবিষ্যৎ ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। সরকার নির্দেশিত নিয়মাবলি মেনে না চললে দর্শনাবাসীর পরিণতি হতে পারে ইতালি ও আমেরিকার মতো ভয়াবহ। তাই নিজের ও পরিবার-পরিজনের ভালোর জন্য সকলকে সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। এছাড়া চুয়াডাঙ্গা-১ আসনের সংসদ সদস্য সোলায়মান হক জোয়ার্দ্দার ছেলুন, চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের সংসদ সদস্য হাজি আলী আজগার টগর, চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার, পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম ও চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জনের প্রতি অনুরোধ করে বলেছেন, মুমূর্ষু রোগীর জন্য উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা করা হোক। এ ক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে বিশেষ তহবিল গঠন করলে জেলাবাসীর সুবিধা হবে। দামুড়হুদা উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. আবু হেনা জামান শুভ বলেছেন, জেলা প্রশাসক ঘোষিত লকডাউন অমান্যকারীর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সরকারের নির্দেশনা মোতাবেক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে নিজে যেমন সুস্থ থাকবেন, তেমনই পরিবার পরিজনকেও সুস্থ রাখতে সহায়ক হবেন। দর্শনা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব গোলাম ফারুক আরিফ বলেছেন, দর্শনা পৌরসভার ৫ ও ৭নং ওয়ার্ডের ঘোষিত লকডাউনের বিভ্রান্তি দূরীকরণের পাশাপাশি বিজ্ঞানভিত্তিক স্বাস্থ্যবিধি মোতাবেক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। সেই সাথে সকলকে সরকারের নির্দেশনা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। প্রশাসনের প্রতি অনুরোধ দর্শনায় শতভাগ মানুষকে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ব্যবস্থা করুন। সচেতন মহল অভিমত ব্যক্ত করে বলেছে, দর্শনায় করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেয়া না হলে এ শহরে মহামারী আকার ধারণ করবে। লাফিয়ে লাফিয়ে যেমন বাড়বে আক্রান্তের সংখ্যা, তেমনই লাশের সারি হবে দীর্ঘ। তাই পুলিশ প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক, ব্যবসায়ি ও জনপ্রতিনিধিদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সম্ভব করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ।