স্টাফ রিপোর্টার: উচ্চ তাপমাত্রায় বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে কৃষি খাত। দেশব্যাপী তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে ধান, আম, লিচু ও তুলাসহ অন্যান্য ফসলের। এছাড়া ভুট্টা ও সয়াবিন উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা আছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষি ও কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব পড়েছে। এতে ফসল উৎপাদনে ধস নামতে পারে। ফলে চিন্তার বলি রেখা পড়ছে কৃষকের কপালে। বিষয়টি ভাবাচ্ছে সরকারের নীতিনির্ধারকদেরও। কারণ ফলন কম হলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে আমদানি বাড়াতে হবে। এতে বাড়বে আমদানি ব্যয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবমতে চলতি মাসের প্রথম ১৬ দিনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ১ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিলো। সোমবার চুয়াডাঙ্গায় তাপ বেড়ে ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিলো। এখন পর্যন্ত এটাই চলতি মরসুমের সর্বোচ্চ এবং বিগত ৫৮ বছরের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্র। এটা ধানের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) ওয়েবসাইট অনুযায়ী, তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠলেই তা ধানের জন্য অসহনীয় হয়ে ওঠে। দেশের প্রায় সবখানেই তাপমাত্রা এখন এ সীমা অতিক্রম করেছে। কিছুদিন আগে রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে কয়েকটি এলাকার ধান গাছে ব্লাস্টার রোগ দেখা দেয়। এ রোগে ধান গাছের পাতা ও ধানের শীষ ঝলসে গেছে। এখন আবার অতি গরমের ধান চিটা হয়ে বিনষ্ট হচ্ছে। এসব কারণে ফলনে ধস নামার শঙ্কা আছে। এছাড়া খড়ার কারণে ধান, মৌসুমি ফল ও সবজির বাগানে বাড়তি সেচ লাগছে। এতে উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। সেচে বিদ্যুৎ ও ডিজেল ব্যবহারেও উপকৃত হচ্ছে না কৃষক। কারণ বিদ্যুৎ ও তেলের দাম কয়েক দফা বেড়েছে। গত ১০ এপ্রিল সব ধরনের সারের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫ টাকা। বাড়তি ব্যয়ের সঙ্গে কৃষিতে যোগ হয়েছে বৈরী আবহাওয়া। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন বৈরী আবহাওয়ায় কীভাবে ভালো ফসল উৎপাদন করা যায় তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তারা বলছেন গত বছর বর্ষায় বৃষ্টিই ছিলো না। তারপরও শেষ পর্যন্ত একটা ব্যবস্থা হয়েছে। আগামী দিনে আরও খারাপ পরিস্থিতি আসতে পারে। ফলে আগে থেকে প্রস্তুতি থাকলে খারাপ অবস্থা মোকাবিলা করা সহজ হবে।
জানতে চাইলে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষকের জন্য দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে বৈরী আবহাওয়া। দাবদাহের ফলে ধান চিটা হয়ে যাচ্ছে। বৈরী আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণে সরকারের কিছুই করার নেই। তবে কৃষক ভালো নেই তা নির্ভেজাল সত্য। তিনি বলেন, কয়েক দফা বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। সেচ কাজে বিদ্যুতের ব্যবহার করে বাড়তি বিল কৃষককেই পরিশোধ করতে হচ্ছে। মোট কথা কৃষকের জন্য কোনো সুসংবাদ নেই। সরকার যতই বলুক এবছর ধান চাষে কৃষককে লোকসান গুনতে হবে বলে মন্তব্য করেন সাবেক এই সচিব। তিনি বলেন খড়া, অতি উচ্চ তাপমাত্রাসহ নানা কারণে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ধানসহ সব ধরনের ফসলের উৎপাদন কম হবে গড়ে ৩০-৪০ শতাংশ। এছাড়া সরকারিভাবে ধানের উৎপাদন খরচ নির্ধারণ নিয়েও তিনি সমালোচনা করেন। প্রসঙ্গত, প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ ধরা হয়েছে ২৮-২৯ টাকা। তিনি বলেন, সরকারিভাবে প্রতি মন ধানের মূল্য ধরা হয়েছে এক হাজার দুইশ টাকা। এটা মোটেও ঠিক হয়নি। কৃষকের উৎপাদন ব্যয় সঠিকভাবে হিসাব করা হয়নি। ১ হাজার ২শ টাকা দরে ধান বিক্রি করলে কৃষকের পোষাবে না।
এদিকে দাবদাহের ফলে আম ও লিচু ঝরে পড়ছে। ফলে আগামী মরসুমে আম ও লিচুর ফলন কম হতে পারে। এতে বাজারে জোগান কম থাকলে ভোক্তা পর্যায়ে দাম বেড়ে যাবে। ভুট্টা ও সয়াবিনের ফসলও কম হবে বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানান।
জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রবীন্দ্রশ্রী বড়ুয়া বলেন, কৃষির প্রধান শত্রু বৈরী আবহাওয়া। যে কোনো খারাপ পরিস্থিতির প্রত্যক্ষ শিকার কৃষক। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ সব ধরনের খারাপ পরিস্থিতি প্রথম আঘাত আসে কৃষির ওপর। তিনি আরও বলেন, এ বছর অস্বাভাবিক গরম পড়ছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুবই কম। জরুরি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডকে সেচ চালু রাখতে বলা হয়েছে। কোনো ধরনের বিরতি ছাড়া রাত ১১টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত সেচ সচল রাখতে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ধান গাছের গোড়ায় দুই থেকে তিন ইঞ্চি পানি রাখতে বলা হয়েছে। আম ও লিচুসহ সব ধরণের ফল গাছের গোড়ায় কয়েক ইঞ্চি গর্ত করে নিয়মিত পানি দিতে বলা হয়েছে। এছাড়া ফলের বাগানে নিয়মিত পানি ছিটানোর জন্য বলা হয়েছে। সবজির জমিতে মাটির ধরন বুঝে প্রয়োজন অনুযায়ী দুই তিনদিন পর পর সেচের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ফল ও সবজির চারাকে তাপপ্রবাহের ক্ষতি থেকে রক্ষার জন্য সেচ নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, জলবায়ু সহিষ্ণু নতুন জাতের ধানের ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্রি ৮৯ এবং ৯২ জাতের ধান চাষ করতে কৃষকদের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জাত দুটি থেকে ভালো ফসল আসে।