সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি: ঝিনাইদহের শেখপাড়ায় বাড়িতে হামলা ও ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রী উলফাত আরা তিন্নীর মৃত্যুর ঘটনায় মামলা দায়ের করেছেন তার মা হালিমা খাতুন। বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং ঘরে ঢুকে তার ছোট মেয়েকে ধর্ষণ করে মেজ মেয়ের সাবেক স্বামী জামিরুল ইসলাম। এ ঘটনার পর লজ্জা অপমান ও দুঃখে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়ে তিন্নী আত্মহত্যা করে বলে এজাহারে উল্লেখ করেছেন হালিমা খাতুন। শৈলকুপা থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. মুহসিন আলি জানিয়েছেন, মামলার আটজনকে এজাহার নামীয়সহ আরও ৪-৫ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। পুলিশ ইতোমধ্যে এ ঘটনায় চারজনকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন শেখপাড়া গ্রামের আমিরুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, লাবিদ ও তন্ময়। এদিকে এ ঘটনার প্রতিবাদে শনিবার সকালে ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের গেটে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসী মানববন্ধন করেছে। তারা আসামিদের গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, জামিরুল ইসলামের সঙ্গে বাদির মেজ মেয়ের প্রায় ১২ বছর আগে বিয়ে হয়। বিয়ে পর থেকে জামিরুল স্ত্রীকে নির্যাতন করতো। গত বছর তার মেয়ে জামিরুলকে তালাক দেয়। এরপর থেকে জামিরুল ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের পরিবারকে নানা হুমকি দিয়ে আসছিলো। বৃহস্পতিবার রাতে সে দলবল নিয়ে এসে হামলা ও ভাঙচুর করে। এরপর দোতলায় ছোট মেয়ের ঘরে ঢুকে জামিরুল তাকে ধর্ষণ করে। এসময় অন্য আসামিরা তাকে সহায়তা করে। পরে অপমান ও দুঃখে সে ফ্যানের সঙ্গে ওড়না বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মুনতাসিরুল ইসলাম জানান, ঘটনাটি পুলিশ সর্ব্বোচ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে। অভিযুক্ত অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান চালানো হচ্ছে।
এদিকে ঘটনার ওই রাতে উলফাত আরা তিন্নীর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন তার মা ও বোন। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতোকোত্তর উলফাত আরা তিন্নীর মরদেহ উদ্ধারের আগে বাড়িতে হামলা চালায় মেজ বোনের সাবেক স্বামী জামিরুল। নিজের শোবার ঘরে বোনের সাবেক স্বামীর হাতে লাঞ্ছিত হওয়ার পর মায়ের সঙ্গে তিন্নীর শেষ কথা ছিলো, ‘বাইরের লোক কেনো আসবে আমার রুমে? আমারতো সব শেষ, বেঁচে থেকে কী লাভ?’ এরপর রাত ১২টার দিকে ঝুলন্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয় উলফাত আরা তিন্নীর। ওই রাতে তিন্নীর সঙ্গে জামিরুল ও তার দলবলের যা ঘটে, তা উঠে এসেছে তার মা ও বোনের কথায়। গতকাল শনিবার সেসব কথা জানিয়েছেন তারা।
ঝিনাইদহের শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামে তিন্নীর বাড়ি। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে নিজের ঘর থেকেই তার মরদেহ উদ্ধার হয়। মা হালিমা বেগম বলেন, ‘বৃহম্পতিবার তিন্নী এক বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠানে কুষ্টিয়া গিয়েছিলো সে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফেরে রাত ৮টার দিকে। এর কিছুসময় পর মেজো মেয়ে মিন্নীর তালাকপ্রাপ্ত স্বামী জামিরুল গোপনে তিন্নীর রুমে ঢোকে এবং খাটের নিচে লুকিয়ে থাকে। তিন্নী বাইরে থেকে এসে পোশাক বদল করে বাসার নিচতলায় মায়ের সঙ্গে দেখা করে, একটু বসে। এরপর ঘুমাতে তার রুমে যায়।’ তিন্নীর মা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আরও বলেন, ‘এরপর তিন্নী বুঝতে পারে তার খাটের নিচে কেউ লুকিয়ে আছে। লোকটি খাটের নিচ থেকে বের হয়ে এক পর্যায়ে তিন্নীকে জাপটে ধরে। শুরু হয় ধস্তাধস্তি, এসময় চিৎকার দেয় তিন্নী। লোকটি ছিলো জামিরুল।’ হালিমা বেগম বলেন, ‘আমরা তখন বুঝতে পারি বাসার চারপাশে জামিরুলের অনেক সহযোগী এবং তারা আমাদের বলতে থাকে- কোনও হৈ চৈ করবি না। আজ সবাইকে মেরে ফেলবো।’
এর পরের ঘটনার বর্ণনা দেন তিন্নীর মেজো বোন মিন্নী। তিনি জানান, বোনের চিৎকারে তিনি ছুটে যান তিন্নীর রুমের সামনে। কিন্তু রুম ছিলো ভেতর থেকে আটকানো। মিন্নী বলেন, ‘অনেক চেষ্টা করে দরজার লক ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি সেখানে জামিরুল। তখনো তারা ধস্তাধাস্তি করছে। বাধা দিতে গেলে সে আমাকে মারতে আসে। আমি অন্য রুমে গিয়ে আত্মরক্ষা করি। এরপর অনেক সময় চলে তিন্নীর রুমে তা-ব। পরে রুম থেকে বের হয়ে আমাকে ও আমার মাকে খুঁজতে থাকে সে। এক পর্যায়ে প্রতিবেশীদের উপস্থিতি টের পেয়ে রাত ১১টার দিকে জামিরুল পালিয়ে যায়।’
মা হালিমা বেগম জানান, জামিরুল বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার পর তিন্নী নিচে তার রুমে আসে। ‘আমাকে সে প্রশ্ন করে, বাইরের লোক কেনো আমার রুমে প্রবেশ করলো মা? আমার তো সব শেষ! আমার আর বেঁচে থেকে কী লাভ? এই বলে তিন্নী নিজের রুমে চলে যায়। এরপর রাত ১২টার দিকে টের পাই তিন্নী রুমে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলছে’। এক প্রশ্নের জবাবে মিন্নী জানান, জামিরুল যখন তার স্বামী ছিলেন তখন এ বাড়িতে এলে ওই রুমেই থাকতেন এবং জামিরুল হয়তো ভেবেছিলেন এখনও সে (মিন্নী) ওই রুমেই থাকে।
মিন্নী বলেন, ‘আমাকে তুলে নিতে বা মেরে ফেলতে সে এ রুমে লুকিয়ে ছিলো জামিরুল। তালাকের পর সে বিশ্বাস করেনি- আমার আবার বিয়ে হয়েছে। সে আমাকে ফিরিয়ে নিতে চেষ্টা চালাতে থাকে। আমার কাছ থেকে মেয়েকে সে জোর করে তার কাছে নিয়ে যায়। এ নিয়ে কয়েকবার তিন্নীর সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি হয়।’
পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন তিন্নী: তিন্নীদের ভাই না থাকায় চাকরি পেয়ে পরিবারের হাল ধরতে চেয়েছিলেন তিন্নী। কাঁদতে কাঁদতে তিন্নীর মা বলেন, ‘আমি আর কী নিয়ে থাকবো। অনেক চেষ্টা করেছি তাকে বিয়ে দিতে। কিন্তু সে কোনো সময় রাজি হয়নি। শুধু বলতো, মা দোয়া করো আমি চাকরি পেয়ে সংসারের যেনো হাল ধরতে পারি।’ ঝিনাইদহের শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মৃত ইউসুফ আলীর মেয়ে তিন্নী ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ২০১২-১৩ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী ছিলেন। এ ঘটনার পর থেকেই পলাতক রয়েছে জামিরুল।
এদিকে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) সাবেক ছাত্রী উলফাত আরা তিন্নির রহস্যজনক মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তার সহপাঠী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে এসব দাবি নিয়ে মানববন্ধন করেন তারা। এ সময় শিক্ষার্থীরা মুখে কালো কাপড় বেঁধে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানান। ‘এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি চাই না, তদন্ত চাই, তদন্ত চাই, তিন্নীর রহস্যজনক মৃত্যুর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই, ইত্যাদি ব্যানার হাতে মানববন্ধন করে শিক্ষার্থীরা। তাদের আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে তিন্নি হত্যার বিচার দ্রুত নিশ্চিতকরণে ও সারাদেশে নারীর ওপর সহিংসতা বন্ধের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়ন ইবি সংসদ। দুপুরে সংসদের দফতর সম্পাদক পিয়াস পান্ডে স্বাক্ষরিত যৌথ বিবৃতিতে সভাপতি নুরুন্নবী ইসলাম সবুজ ও সাধারণ সম্পাদক জি কে সাদিক এসব দাবি জানান।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, তিন্নীর এ রহস্যজনক মৃত্যু জাতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। আমরা প্রশাসনের কাছে এ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত এবং এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ বিচার চাই। যদি তা না হয় তাহলে এর থেকে তীব্র আন্দোলনে যাবো।
তারা আরও বলেন, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে চায় না বাংলার মানুষ। এ জন্য দেশের ছাত্রসমাজকে সোচ্চার ও আন্দোলন করতে হবে। ছাত্রসমাজ ছাড়া এসব ঘটনার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ালেও খুব বেশি কাজ হয় না।
মানববন্ধনে একাত্মতা প্রকাশ করে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রমৈত্রীর নেতৃবৃন্দ। তিন্নীর স্বজনরাসহ শতাধিক শিক্ষার্থী মানববন্ধনে অংশগ্রহণ করেন।
শৈলকুপা থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পড়ালেখা শেষ করা মেধাবী ছাত্রী তিন্নীর মৃত্যুতে শুক্রবার রাতে ৮ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত ১২ জনের নামে শৈলকুপা থানায় ধর্ষণ ও আত্মহত্যার প্ররোচনা মামলা দায়ের করা হয়েছে। তিন্নির ময়না তদন্ত রিপোর্ট এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি। তবে প্রাথমিকভাবে ময়না তদন্তে ধর্ষণের আলামত রয়েছে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার রাতে বড় বোন মিন্নির সাবেক স্বামী জামিরুল স্ত্রীকে আবারো ফিরিয়ে নিতে ঝিনাইদহের শৈলকুপার শেখপাড়া গ্রামের বাড়িতে লোকজন নিয়ে আসে এবং তারা বাড়ি ঘর ভাংচুর করে। এসময় তিন্নি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ছিলো। ভাংচুরের সময় বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে চেচামেচি শুনে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে জামিরুল ও তার লোকজন পালিয়ে যায়। ঘটনার পর তিন্নির কোনো সাড়া না পেয়ে দ্বিতীয় তলায় তার রুমের ভেতর থেকে লাগানো দরজা ভেঙে তারা তিন্নিকে ফ্যানের সাথে ঝুলতে দেখে। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করেন।