টুঙ্গিপাড়া কোটালীপাড়া ও কালকিনিতে বিশাল জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
স্টাফ রিপোর্টার: আগামী নির্বাচনে জয়ী হলে মানুষ পোড়ানোর হুকুম দেয়ার জন্য বিএনপি নেতা তারেক রহমানকে লন্ডন থেকে ধরে এনে শাস্তির মুখোমুখি করার কথা জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ওই লন্ডনে বসে হুকুম দেবে আর আমার দেশের মানুষের ক্ষতি করবে, দেশের মানুষকে মারবে, তা হবে না। আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারলে, দরকার হলে ওটাকে ওখান থেকে ধরে এনে শাস্তি দেয়া হবে। গতকাল গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়া এবং মাদারীপুরের কালকিনিতে পৃথক জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে নির্বাচনের মাধ্যমে তৃতীয় দলকে ক্ষমতায় আনতে আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচন বাতিলের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের জবাব দেবে দেশবাসী। তিনি বলেন, নির্বাচন বাতিলের জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। অনেকে আন্তর্জাতিকভাবেও জড়িত। তারা বাংলাদেশে তৃতীয় পক্ষকে ক্ষমতায় আনার জন্য কাজ করছে। আমরা ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের মাধ্যমে ষড়যন্ত্রের উপযুক্ত জবাব দেব। দুই দিনের সফরে গত শুক্রবার সড়ক পথে বরিশাল যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐ দিন বিকালে বরিশাল নগরীর বঙ্গবন্ধু উদ্যানে জনসভায় যোগদান শেষে সন্ধ্যায় নিজের পিতৃভূমিতে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। নির্বাচনি এ সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আছে তার ছোট বোন শেখ রেহানা। শুক্রবার সন্ধ্যায় টুঙ্গিপাড়ায় পৌঁছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার দুই কন্যা। শনিবার তিনটি জনসভা শেষে সন্ধ্যায় সড়কপথে ঢাকায় ফেরেন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। টুঙ্গিপাড়ার জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, ‘আগামী ৭ জানুয়ারি আমাদের নির্বাচন। নৌকা মার্কায় আমরা ভোট করব। আপনারা সবাই সকালে সকালে সশরীরে এসে ভোট দিয়ে এই বিশ্বকে দেখাবেন যে, এই নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং আমরা তা করতে জানি ও করতে পারি। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন আমরা করতে পারি।’ তিনি বলেন, তিনি চান দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হোক। আওয়ামী লীগ সভাপতি টুঙ্গিপাড়াবাসীর সমর্থনকে নিজের শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তার দায়িত্ব নেওয়ার জন্য তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি বলেন, ‘আমি ৩০০ আসন দেখি। আর আমাকে দেখেন আপনারা। কাজেই এটাই হচ্ছে আমার সব থেকে বড় পাওয়া, আমার মতো একজন সৌভাগ্যবান প্রার্থী বাংলাদেশে আর নেই। এটা হলো বাস্তবতা। তার কারণ আপনারা। আপনারাই আমার দায়িত্ব নেন। আপনারা আমাকে দায়মুক্ত করে রেখেছেন বলেই বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে আমরা কাজ করতে পারছি। আমি একজন প্রার্থী হিসেবে নৌকা মার্কায় ভোট চাই, ভোট দেবেন তো?’ তার এই প্রশ্নের উত্তরে সমস্বরে চিৎকার করে জনতা দুই হাত তুলে ভোট প্রদানের সম্মতি জানায়। ‘আমি জানি আপনারা দেবেন প্রতিউত্তর দেন শেখ হাসিনা।’ প্রধানমন্ত্রী তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে বেলা সোয়া ১১টায় সমাবেশস্থলে পৌঁছান এবং সমাবেশে জাতীয় পতাকা নেড়ে জনতাকে শুভেচ্ছা জানান। সমাবেশটি একটি জনসমুদ্রে পরিণত হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, হাসপাতালে বোমা মেরে ফিলিস্তিনে নারী শিশুকে হত্যা করা হচ্ছে। রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স, কর্তব্যরত পুলিশ সদস্য ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানোর নির্দেশ দিয়ে (এখানে বাংলাদেশে) একই কাজ করেছে তারেক জিয়া। বাংলাদেশে এসমস্ত দুর্বৃত্তায়ন চলবে না। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আল্লাহ যদি দিন দেয়, আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসতে পারলে ঐ লন্ডনে বসে হুকুম দেবে আর দেশের মানুষের ক্ষতি করবে, দেশের মানুষ মারবে, সেটা হতে পারে না। দরকার হলে ওটাকে ওখান থেকে ধরে এনে শাস্তি দেয়া হবে, ধরে এনে শাস্তি দেব।’ নির্বাচন বানচাল করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র হচ্ছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘তৃতীয় পক্ষ কী করতে পারে? দেশের কোনো উন্নতি করতে পারে না। ২০০৭-এ আপনারা দেখেছেন কী করেছে। তার আগে তো জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়া, এরাই তো ছিল, মানুষের তো ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি! মানুষ তো অন্ধকারেই ছিল।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। এদিকে শেখ হাসিনার নিজের নির্বাচনি এলাকার এই জনসভায় যোগ দিতে শনিবার ভোর থেকে এই মাঠে জড়ো হন এখানকার মানুষ। ঢাকঢোল, বাদ্যযন্ত্রের তালে নেচেগেয়ে উৎসব করতে করতে নানা রঙের পোশাক পরে খ- খ- মিছিল নিয়ে মাঠে আসেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী, সমর্থকেরা। সকাল ১০টা নাগাদ পুরো মাঠ কানায় কানায় ভরে গিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে জনস্রোত। নিজের পিতৃভূমিতে বঙ্গবন্ধু কন্যার আগমনে গোটা গোপালগঞ্জ, টুঙ্গিপাড়া, কোটালীপাড়ায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করে। নৌকার আদলে তৈরি বিশাল মঞ্চে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। টুঙ্গিপাড়ার জনসভা শেষে কোটালিপাড়ায় যান শেখ হাসিনা।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আবুল বশার খায়েরের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক বাবুল শেখের সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর চাচা শেখ কবির হোসেন, গোপালগঞ্জ দুই আসনের সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, শেখ হেলাল, শেখ জুয়েল, শেখ সারহান নাসের তন্ময়, প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন প্রতিনিধি শহীদুল্লাহ খন্দকার, গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব আলী খান, সাধারণ সম্পাদক জি এম শাহাবুদ্দিন আজম, পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ সাইফুল ইসলামসহ অভিনেত্রী তারিন ও অভিনেতা মীর সাব্বির বক্তব্য রাখেন।
টুঙ্গিপাড়ার জনসভা শেষে কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান কলেজ মাঠে আয়োজিত আরেকটি মহাসমাবেশে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে নতুন ভোটার ও তরুণদের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যারা যুবসমাজ ও তরুণ সমাজ এবং প্রথম বার যারা ভোটার হবেন, শুধু কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়া নয়, সারা বাংলাদেশের জন্য আমার আহ্বান, নতুন ভোটাররা নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করার সুযোগ করে দিয়ে বাংলাদেশ যেভাবে উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে, সেই উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ায় তাদের সাহায্য করতে হবে। তিনি বলেন, তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের অগ্রগতি। সেটাই আমরা বিশ্বাস করি।
আধুনিক প্রযুক্তিগত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তরুণ প্রজন্মকে স্মার্ট ও দক্ষ জনশক্তি হিসেবে তার সরকার গড়ে তুলবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের সরকার, আমাদের অর্থনীতি এবং আমাদের সমাজব্যবস্থাও স্মার্ট করে গড়ে তোলা হবে। যেন এই বাংলাদেশ শিক্ষা-দীক্ষা জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এবং প্রযুক্তিতে উন্নত সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে চলতে পারে। কারো কাছে মাথা নত করে নয়।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘আজকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিএনপি-জামায়াত জোট মিলে অগ্নিসন্ত্রাস ও মানুষ হত্যা শুরু করেছে। রেলের বগিতে আগুন দিয়ে মা ও শিশুকে পুড়িয়ে মারে। রাস্তাঘাটে যেখানে-সেখানে আগুন দেয়, বাসে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করে। এই দুর্বৃত্তপরায়ণতা আমাদের বন্ধ করতে হবে। যে যেখানে আছেন ্ওই আগুন যারা দেয় বা মানুষকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র যারা করে ওদেরকে ধরিয়ে দিন, উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করে দিন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি আমাদের অন্যান্য এমপিদের নিজের এলাকা নিয়েই পড়ে থাকতে হয়, কিন্তু আমার তো এলাকা ৩০০টি। এই ৩০০ এলাকাই আমাকে দেখতে হয়। আমি দেখতে পারি কারণ, আমার দায়িত্ব তো আপনারাই নিয়েছেন। আমার নির্বাচন তো আপনারাই করে দেন সবাই মিলে। সেদিক থেকে আমি সবচেয়ে সৌভাগ্যবান। আমি আজকে সেজন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, এই বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ। মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ-সব ধর্মের মানুষ তার সমান অধিকার নিয়ে যার যার ধর্ম সে সে পালন করবে, সেটাই আমরা নিশ্চিত করেছি এবং সেটাই নিশ্চিত থাকবে।
কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভবেন্দ্রনাথ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজ নির্বাচনি এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ও সাবেক সিনিয়র সচিব মো. শহীদ উল্লা খন্দকার, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি মুজিবুর রহমান হাওলাদারসহ যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক, ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।
সবশেষে মাদারীপুরের কালকিনিতে সৈয়দ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত আরেকটি মহাসমাবেশে শেখ হাসিনা তার দলের নির্বাচনি প্রতীক নৌকায় ভোট চেয়ে বলেছেন, একমাত্র নৌকাই পারে দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে। তিনি বলেন, আমি নৌকায় ভোট চাই, কারণ, এটিই একমাত্র দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে। নৌকাই দেশের উন্নয়নের একমাত্র হাতিয়ার। কোটালীপাড়ার সমাবেশের মতো তিনি নতুন ভোটারদের কাছেও নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে বলেন, তার সরকার তরুণ প্রজন্মকে কম্পিউটার ও আইসিটির যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে। যাতে তারা বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে বিকাল সাড়ে ৩টায় সমবেশস্থলে এসে পৌঁছান, যা ততক্ষণে মানব সমুদ্রে পরিণত হয়। অওয়ামী লীগ সভাপতি মাদারীপুরের তিন আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে জনগণের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন এবং নৌকার পক্ষে ভোট চান।
প্রধানমন্ত্রী সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য ও যোগাযোগমন্ত্রী প্রয়াত সৈয়দ আবুল হোসেনকে পদ্মা সেতু নির্মাণে অবদানের জন্য শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগের প্রতিবাদে তার সরকার নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির ভুয়া অভিযোগ পরবর্তী সময়ে কানাডার ফেডারেল কোর্টেও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। কোনো নাম উল্লেখ না করে, নিয়মবহির্ভূতভাবে ব্যাংকের এমডির পদ ধরে রাখার জন্য এক ব্যক্তি এসব ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে ছিলেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সমাবেশে আরো বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য শাহজাহান খান, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ প্রমুখ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আবুল কালাম আজাদ। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী।