ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

দেশের সব নাগরিককে সুরক্ষা দেবো : রক্তচক্ষু-ধমক আমলে নেবেন না

স্টাফ রিপোর্টার: কাজের ক্ষেত্রে কারো রক্তচক্ষু বা ধমক আমলে না নেয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাঠ প্রশাসনকে আইন অনুযায়ী দেশের জন্য কাজ করতে বলেছেন। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের শাপলা হলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, কারও রক্তচক্ষুর কারণে, কারো ধমকের কারণে কোনো কাজ করার প্রয়োজন নাই। অন্তত এ (অন্তর্বতী সরকারের) সময় টুকুতে। আমি নিজের মতো করে যেটাই আইন, যেটা দেশের জন্য করা দরকার সেটা করবো। সে কাজেই আমি ব্যস্ত থাকবো যাতে আমি করতে পারি। সরকার মানেই হয়রানি এ ধারণা উল্টে দেয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিনা কারণে মানুষকে হয়রানি করা হয়। হয়রানি করাটাই যেন আমাদের ধর্ম! সরকার মানেই মানুষকে হয়রান্তি এটার থেকে উল্টে দাও। সরকার ভিন্ন জিনিস, আপনার অধিকার আপনার দরজায় পৌঁছে দেয়া আমাদের কাজ। এটাই যেন আমরা স্মরণ রাখি। দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়ার নির্দেশনা দিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমরা যেহেতু এমন পরিস্থিতিতে এসেছি, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখা মস্ত বড় ইস্যু হয়ে গেল। এটাতে আমরা কে কী পরিমাণে অগ্রসর হলাম, কী করণীয়তা এটা এক নম্বর বিবেচ্য বিষয়। আইন-শৃঙ্খলায় আমরা যেন বিফল না হই, কারণ এটাতে আমাদের সমস্ত অর্জন সফলভাবে অর্জিত হতে বা বিফলতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেটাই নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হোক। ফিরে যাওয়ার পর যেন এটা বোঝার মধ্যে কোনো গলদ না থাকে। দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে তোষামোদ বা চাটুকারিতার যে সংস্কৃতি চালু রয়েছে তা থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা যা করি, যা চিন্তা করি, যা পরিকল্পনা করি-সেটাই সরকার, সেটাই সরকারের চিন্তা, সরকারের ভাবনা। সেটাই সরকারের কর্তব্য। কাজেই এই মহাশক্তি নিয়ে আমরা কী কাজ করব, কী কাজের জন্য আমরা তৈরি, কী কাজে আমরা সফল, কী কাজে আমরা বিফল-সেগুলোই আজকের সমাবেশের আলোচ্য বিষয়। সেখানে কাউকে স্তুতি দিয়ে সময় নষ্ট করার কোনো সুযোগ নেই। এই স্তুতি বাক্য পরিহার করার আমরা একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সভা-সমিতিতে স্তুতি বাক্য খুব অগ্রহণযোগ্য জিনিস বলে আমরা চালু করব।’ সরকার পরিচালনাকে খেলার দলের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে যা কিছু করণীয়, সেই করণীয়র দায়িত্বে আমরা সবাই আছি; এমনভাবে চিন্তা করুন, আমরা একটা খেলার-ক্রিকেট বা ফুটবল খেলার খেলোয়াড়। আমাদের আজকে এই খেলোয়াড়দের সমাবেশ। প্রস্তুতি নেয়া যে- আমাদের স্ট্র্যাটেজি কী হবে, অবজেকটিভ কী হবে, আমাদের কার কী করণীয়-এসব ঠিক করা।’ ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা টিম হলাম কি না? যদি এটা বাংলাদেশ সরকার হয়ে থাকে, বাংলাদেশ সরকারকে একটা টিম হতে হবে। এটা টিম ওয়ার্ক। এটা এমন না যে-আমি আমার মতো করলাম, ও ওর মতো করলো-ওইটা হয় না, কোনো কাজেই হয় না। টিম গঠনের জন্য যখন একত্রিত হয়-তখন টিমের চিন্তা, করণীয় সেগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। কার কী আছে, তোমার কারণে আমারটা নষ্ট হচ্ছে। কাজেই খেলা হলো একটা সামগ্রিক জিনিস। একজনের ভুল কাজে পুরো টিম তার সাফল্য থেকে বঞ্চিত হয়। কাজেই আমরা কেউ যেন এমন কোনো ভুল কাজ না করি- যাতে করে পুরো টিমের সাফল্য ব্যাহত হয়; আমাদের গন্তব্যে পৌঁছানো ব্যাহত হয়। এটা নিয়েই আমাদের আলোচনা- আমরা কী করছি।’ গত ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই দিন বাদে শান্তিতে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা করে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাঠামোর সংস্কার শেষে চলতি বছর নাগাদ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে চায় এই সরকার।
ইউনূস বলেন, ‘সরকার গঠনের পর থেকে ছয় মাস চলে গেল। এটা আমাদের প্রথম পর্ব। আয়োজন করার জন্য যে সময় লাগে; অনেক ভুল-ভ্রান্তি হয়েছে এই আয়োজনের সময়। এখন সেগুলো ঠিকঠাক করে আমরা পুরো খেলার জন্য প্রস্তুত। সেই প্রস্তুতিটা আমাদের হলো কি না, না হলে কী কী ঘাটতি আছে, সেগুলো ঠিক করা। এটা যদি কোনো কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টরদের কোনো বৈঠক হতো, তাতে যারা শরিক হচ্ছে-তারা কী বলতো? নিশ্চয় ম্যানেজিং ডিরেক্টরের প্রশংসায় সময় নষ্ট করতো না। তারা বলতো, ‘এই কাজ দিয়েছেন আমাকে, আমি এই কাজ করেছি, আমার এই সাফল্য হয়েছে, আমি আরও এই কাজের জন্য প্রস্তুত’। আমি দুইভাবে দেখালাম-একটা হলো মাঠের খেলার খেলোয়াড়, আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের ফিল্ড অফিসারদের বক্তব্য। এই সরকারের যারা খেলোয়াড় আছে, তাদের এই ভূমিকা ওই দুই গোষ্ঠীর মধ্যে কোনটার মতো হতে হবে? আমরা কী করছি, কী করা দরকার, কোথায় আমরা আটকে যাচ্ছি- সেগুলো নিয়ে আলোচনা।’ বক্তব্যে এ পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাকে প্রধান অতিথি বলায় একটু কষ্ট পেলাম-যেন আমাকে বাইরে রাখা হলো। এই খেলার মাঠ থেকে হওয়া উচিত ছিল তো আমাকে খেলার ক্যাপ্টেন, কিন্তু আমাকে করলো অতিথি! আমি অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখতে চাই না, আমি ক্যাপ্টেন হিসেবে বক্তব্য রাখতে চাই-আমাদের করণীয় কী। কাজ কি আমাদের একেবারে হাতেগোনা মাপা জিনিস? এটা নিত্যনৈমিত্তিক, নতুন কিছু আসে তা না; একই জিনিস বারেবারে আসছে, বিভিন্ন ভঙ্গিতে আসছে। সেগুলো আমরা কে কীভাবে করছি, কী হলে আরও ভালো হতো, কোঅর্ডিনেশনটা কীভাবে হলে ভালো হতো, ক্যাপ্টেনের সিগনালটা কীভাবে ফিল্ডে গেলে ভালো হতো-এসব নিয়েই আলোচনা।’ আইনশৃঙ্খলায় জোর: ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিনই হামলা চালানো হয় থানাসহ পুলিশের বিভিন্ন স্থাপনায়। লুটপাট-ভাঙচুর করে আগুন দেয়া হয়। হামলা হওয়া থানাগুলোতে ধ্বংস হয়ে যায় মামলার নথি, আলামতসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সবকিছু। এরপর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটে। মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমরা যেহেতু এমন পরিস্থিতিতে এসেছি, শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা মস্ত বড় ইস্যু হয়ে গেল। এতে আমরা কে কী পরিমাণে অগ্রসর হলাম, কী করণীয়-এটা এক নম্বর বিবেচ্য বিষয়। আইনশৃঙ্খলায় আমরা যেন বিফল না হই, কারণ এতে আমাদের সমস্ত অর্জন সফলভাবে অর্জিত হতে বা বিফলতায় পর্যবসিত হতে পারে। সেটাই নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা হোক। ফিরে যাবার পর যেন এটা বোঝাবুঝির মধ্যে কোনো গলদ না থাকে। পরস্পরের যোগাযোগ আনন্দদায়ক এবং সফল হোক। আমাদের এই অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে যেটুকু তোমাদের মাধ্যমে করতে পারব, তোমাদের কারণে আমরাও যেন স্মরণীয় হতে পারি-‘উনাদের সময় ডিসি সাহেব এই কাজগুলো আমাদের করে দিয়ে গেছে’।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এখানে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত, সেগুলো সবার খুব ভালো করেই জানা আছে। পুলিশ প্রশাসনের কাজ কী, সিভিল প্রশাসনের কাজ কী, কো-অর্ডিনেশনের কাজ ক্তীসবাই জানে। কিন্তু যদি বলি, ‘ওর কারণে আমারটা হয় না’, এটা বলে আমরা কিন্তু পার পাবো না। যেহেতু জেলার দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে একজনের ওপরে, তার সঙ্গে কো-অর্ডিনেশন করে সবকিছু করতে হয়। কাজেই সে কো-অর্ডিনেশনের কী সমস্যা, নাকি পৃথকভাবে হব্তেসেগুলো পরিষ্কার করে নেয়া প্রয়োজন, যাতে কাজ করতে গিয়ে আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে না যাই।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের শৃঙ্খলা ভঙ্গ হলে কী করতে হবে, উপর থেকে নিচ পর্যন্ত চেইন অব কমান্ড কীভাবে যাবে-এটা স্পষ্ট থাকতে হবে। এই নয় যে, ‘এটা আমার কাজ ছিল না, আমি এটাতে মনোযোগ দেই নাই’-এভাবে বললে হবে না। আমরা তো সবাই মিলে সরকার। কাজেই এটা থেকে আমাদের উদ্ধার হতে হবে।’ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, ‘নারী-শিশুদের রক্ষা এবং সংখ্যালঘুদের রক্ষা একটা মস্তবড় দায়িত্ব; কারণ এটার উপরে সারা দুনিয়া নজর রাখে আমাদের উপরে। আমরা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করছি- একটা ছোট্ট ঘটনা সারা দুনিয়ায় বিশাল হয়ে যায়।
আমি সেই ভয়ের জন্য বলছি না, এটা আমাদের সরকারের দায়িত্ব-সকল নাগরিকের সুরক্ষা বিধান করা। আমি সংখ্যালঘুদেরও বলেছি, আপনারা সংখ্যালঘু হিসেবে দাবি করবেন না, দেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করুন। সংবিধান আপনাকে অধিকার দিয়েছে, সেই অধিকার আপনাকে সরকারের কাছ থেকে পেতে হবে-এটা আপনাদের পাওনা। আমাদের সরকারের টিমের দায়িত্ব সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। আমি এর সরকার, তারও সরকার।’
এদিকে, ডিসি সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন সোমবার (আজ) কার্য-অধিবেশনের বাইরে সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন ডিসিরা। সন্ধ্যায় তারা সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে প্রধান বিচারপতির আপ্যায়ন আয়োজনে অংশ নেবেন। এবারের সম্মেলনে ৩৪টি কার্য-অধিবেশন থাকছে, যাতে ৩৫৩টি প্রস্তাব আলোচনা হওয়ার কথা। ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্মেলনের শেষ দিন আগামীকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় একটি অধিবেশনে থাকছে নির্বাচন কমিশন। ইসি কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত নির্বাচনের আগে মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বসে নির্বাচন কমিশন। ডিসি সম্মেলনে এবারই প্রথম নির্বাচন কমিশন অংশগ্রহণ করছে। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবার রাষ্ট্রপতির অধিবেশন থাকছে না।