কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আবু হাসানুজ্জামানসহ তিনজনের বিরুদ্ধে হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। এমন অভিযোগে তিন জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। ডা. আবু হাসানুজ্জামানের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতপাল সড়কে বলে মামলায় উল্লেখ্য করা হয়েছে।
দুদক বলছে, এ তিনজন পরস্পর যোগসাজশে ১৭ লাখ টাকার অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ৭১ লাখ টাকায় ক্রয় দেখিয়েছেন। যা বাজারদরের চেয়ে অন্তত তিনগুণ বেশি। শুধু অ্যানেসথেসিয়া মেশিন নয় আইআরআর মেশিনসহ আরও বহু যন্ত্রপাতি তারা তিনগুণ মূল্যে ক্রয় দেখিয়েছেন। দেশের বাজারে প্রতিটি আইআরআর মেশিনের মূল্য ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। অথচ তারা এই মেশিন ৬ লাখ টাকায় ক্রয় দেখিয়েছেন। এ ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মো. সহিদুর রহমান বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলা করেছেন। মামলাটি রেকর্ড করেছেন কুষ্টিয়া জেলা কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক নীলকমল পাল।
মামলার অন্য আসামিরা হলেন, ন্যাশনাল ইলেকট্রো মেডিকেল ইকুইপমেন্ট মেইনটেন্যান্স ওয়ার্কসপ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টারের (নিমিউ অ্যান্ড টিসি) মহাখালী কার্যালয়ের সাবেক অ্যাসিস্ট্যান্ট রিপিয়ার কাম ট্রেনিং ইঞ্জিনিয়ার এএইচএম আব্দুল কুদ্দুস ও রাজশাহীর কেশবপুর মোড় এলাকার প্যারাগন এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটর মো. জাহেদুল ইসলাম।
দুদক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জন্য রাজশাহীর কেশবপুর মোড় এলাকার প্যারাগন এন্টারপ্রাইজের প্রোপ্রাইটার মো. জাহেদুল ইসলামের কাছ থেকে অস্বাভাবিক দামে চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়।
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহের দরপত্র আহ্বানের আগে মেডিকেল যন্ত্রপাতির বাজার দর যাচাই না করে অধিক দরে কার্যাদেশ দেন। পরে মেডিকেল যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে এর মূল্য বাবদ সরকারের অতিরিক্ত ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকা ক্ষতিসাধনপূর্বক পাঁচটি বিলের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন ও আত্মসাৎ করেন। এতে অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
দুদক সূত্র জানায়, সাধারণ ব্যথা, ঘাড় ব্যথা, পেশী ব্যথার চিকিৎসার জন্য টেনস মেশিন ব্যবহার করা হয়। যার বাজার মূল্য ১ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু ক্রয় দেখানো হয়েছে ৩ লাখ ৩০ হাজার টাকা। দুটি টেনস মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ১৭ লাখ ১৮ হাজার ২১৫ টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৭১ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। দুটি অ্যানেসথেসিয়া মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ৩৪ লাখ ৩৬ হাজার ৪৩০ টাকা খরচ করা হয়েছে। ৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ইলেক্ট্রোসার্জিক্যাল কেটারি মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৭ লাখ টাকায়। একটি ইলেক্ট্রোসার্জিক্যাল কেটারি মেশিন ক্রয় করে অতিরিক্ত ৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি আইআরআর মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৬ লাখ টাকায়। পাঁচটি আইআরআর ক্রয়ে অতিরিক্ত ১৮ লাখ ২৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। দাঁতের চিকিৎসার জন্য ২৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ডেন্টাল ইউনিট মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ৪৮ লাখ টাকায়। একটি ডেন্টাল ইউনিট মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ২৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। উচ্চ কম্পাঙ্কের বিদ্যুতের মাধ্যমে কাজ করে ডায়াথার্মি। অপারেশনের সময় শরীরের কোনো অংশ কাটা এবং ছোট ছোট রক্তনালীর রক্তপাত বন্ধ করে এই মেশিন। ৪ লাখ ৭৭ হাজার ৮২৫ টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ডায়াথার্মি মেশিন ক্রয় করা হয়েছে ১১ লাখ ১০ হাজার টাকায়। চারটি ডায়াথার্মি মেশিন ক্রয়ে অতিরিক্ত ২৫ লাখ ২৮ হাজার ৭০০ টাকা খরচ করা হয়েছে। এক লাখ ৭৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি বৈদ্যুতিক স্নায়ু উত্তেজক যন্ত্র ক্রয় করা হয়েছে ৩ লাখ ২০ হাজার টাকায়। দুটি বৈদ্যুতিক স্নায়ু উত্তেজক যন্ত্র ক্রয়ে অতিরিক্ত ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে।
হৃদস্পন্দন ও শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা মাপার যন্ত্রকে পালস অক্সিমিটার বলে। ১ লাখ ৩৯ হাজার ৪০ টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি পালস অক্সিমিটার ক্রয় করা হয়েছে ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকায়। চারটি পালস অক্সিমিটার ক্রয়ে অতিরিক্ত ৮ লাখ ৪৩ হাজার ৮৪০ টাকা খরচ করা হয়েছে। ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি ইসিজি (১২ চ্যানেল) ক্রয় করা হয়েছে ৭ লাখ ৮০ হাজার টাকায়। পাঁচটি ইসিজি ক্রয়ে অতিরিক্ত ২২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ১০ লাখ ৯০ হাজার টাকা বাজারমূল্যের প্রতিটি পেসেন্ট মনিটর ক্রয় করা হয়েছে ১২ লাখ টাকায়। পাঁচটি পেসেন্ট মনিটর ক্রয়ে অতিরিক্ত ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। এই যন্ত্রটি ব্যবহার করে রোগীর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যকলাপ পরিমাপ করা হয়।
দরপত্রের দরে গৃহীত যন্ত্রপাতির মোট দাম ধরা হয়েছিলো ৩ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। বাজারমূল্য অনুযায়ী যন্ত্রপাতির দাম হয় ২ কোটি ৫০ লাখ ১৬ হাজার ৩০ টাকা। বাজার মূল্যের চেয়ে দরপত্রের মূল্যের পার্থক্য ১ কোটি ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭০ টাকা। পার্থক্যের ১ কোটি ৪৮ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭০ টাকা থেকে ভ্যাট বাবদ ৫ শতাংশ, আয়কর বাবদ ৬ শতাংশ এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লাভ বাবদ ১৫ শতাংশ মোট ২৬ শতাংশ হিসেবে ৩৮ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বাদ দিলে দাঁড়ায় ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকা। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১ কোটি ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৯৭০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন আসামিরা।
এ বিষয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক ডা. এমএ মোমেন বলেন, আমি গত তিন মাস আগে এই হাসপাতালে যোগদান করেছি। এ বিষয়ে আমার জানা নেই। কারণ এ ঘটনার অনেক পরে আমি এখানে জয়েন করেছি। আমিও অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি চাই।
কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল আলম টুকু বলেন, শুধু হাসপাতালে নয়, সরকারের প্রায় প্রতিটি প্রকল্পে দুর্নীতি হয়। দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না। দুর্নীতি বন্ধের জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। স্বাস্থ্য খাতে অস্বাভাবিক দামে কেনাকাটা ও দুর্নীতি রয়েছে, এটা নতুন করে বলার কিছু নেই। সরকারের উচিত দফতরগুলোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা। দুর্নীতি দমনের ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
অস্বাভাবিক দামে যন্ত্রপাতি কেনাকাটার বিষয়ে বক্তব্য জানতে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক আবু হাসানুজ্জামানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোন ও হোয়াটস অ্যাপ নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
দুদকের কুষ্টিয়া সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক জাকারিয়া জানান, আসামিরা পরিকল্পিতভাবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের জন্য যন্ত্রপাতি কেনেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়ায় দুদকের প্রধান কার্যালয় মামলার অনুমতি দিয়েছে। এখন পূর্ণ তদন্ত শুরু হবে।