আতিয়ার রহমান : চুয়াডাঙ্গা শহরের কোর্টপাড়ার একটি ভাড়া বাসায় পরিবার নিয়ে থাকতেন হোটেল শ্রমিক চাঁনমিয়া। মাস শেষে বেতন আর বকশিসের উপরি আয়ে ভালোই চলছিলো তার সংসার। প্রতিমাসে ব্যাংকেও কিছু টাকা জমাতেন তিনি। এটি ছিলো তার জীবনের স্বাভাবিক চিত্র। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে চাঁন মিয়ার সংসারের চিত্র পুরোটাই উল্টো। টানা তিন মাস চাকরি নেই, সেই থেকে ঘরভাড়াও বাকি। সন্তানদের জন্য ঘরে খাবার নেই। অবশেষে ব্যাংকে যা জমানো ছিলো তা বাড়িওয়ালাকে দিয়ে জেলার সদর উপজেলার গ্রামে ফিরলো তার পরিবার।
এমন গল্প একটি, দু’টি নয়, চুয়াডাঙ্গা শহরে অহরহ। করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে কর্মহীন হয়ে পড়া অনেক মানুষ শহরের ব্যয়ভার বহন করতে না পেরে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে শহরের বাসাবাড়ি। এসব বাড়ির সামনে ঝুলছে টু-লেট। শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামে ফিরে যাওয়াদের মধ্যে রয়েছেন বেসরকারি স্কুল-কলেজের শিক্ষক, প্রবাসীর পরিবার, বেসরকারি চাকরিজীবী, হোটেল শ্রমিক ও বিভিন্ন মার্কেটের দোকানের কর্মচারীরা। করোনার কারণে যাদের আয় বন্ধ হয়ে রয়েছে। মাস শেষে বাসা ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল, পানির বিল, ইন্টারনেট বিল, ক্যাবল নেটওয়ার্ক (ডিস) বিলসহ নানা খরচে দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে এসব পরিবার।
এদিকে, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু জেলা কিংবা উপজেলা শহর নয়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকেও অনেক পরিবার সংসার গুটিয়ে গ্রামে চলে এসেছেন। এসব পরিবার বলছে, শহরে জীবন চালাতে না পেরে গ্রামে চলে এসেছেন তারা। পরিস্থিতি ঠিক হলে আবার শহরে ফেরার আশাও রয়েছে তাদের।
চুয়াডাঙ্গা শহরের রেলবাজার এলাকার বাসিন্দা চুয়াডাঙ্গা সাংবাদিক সমিতি চুয়াডাঙ্গা ইউনিটের সভাপতি আজাদ মালিতা বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গা শহরে বসবাসকারীদের একটা অংশ প্রবাসী ও গ্রামের অধিবাসী। দেশের মত দেশের বাইরেও করোনার প্রভাবে বেকারত্ব দেখা দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে প্রবাসীদের পরিবারগুলো গ্রামে ফিরে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গা জজ কোর্টের অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম বলেন, শহরের অন্যতম আবাসিক এলাকা ছেড়ে অনেক পরিবার গ্রামে চলে গেছেন। করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া ও আয় কমে যাওয়ায় এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এ তিন মাসে অনেক বাড়িতে ভাড়াটিয়া কমেছে। বাড়ির সামনে ঝুলছে টু-লেট।
চুয়াডাঙ্গা কোর্ট এলাকার ব্যবসায়ী মারুফ বলেন, ‘গত দুই-তিন মাসে লকডাউনের কারণে অনেক ব্যবসায়ীর আয় নেই। তাদের মধ্যে অনেক ব্যবসায়ী পরিবার নিয়ে শহরে থাকেন। আয় না থাকায় শহরে থাকা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শহরে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো। আয় না থাকায় সেসব পরিবার গ্রামে কিংবা শহরের বাইরে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন।
চুয়াডাঙ্গার জেলা ব্যবসায়ী সমিতির দফতর সম্পাদক ও রেল বাজারের বিশিষ্ট হার্ডওয়ার ব্যবসায়ী ফারুক হোসেন বলেন, ‘পৌর শহরের বাসার চাহিদা আগে থেকে অনেক কমে গেছে। অনেক পরিবার শহরের বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রবাসী ও খেটে খাওয়া মানুষের আয় কমে যাওয়ায় এমনটা হচ্ছে বলে ধারণা এই ব্যবসায়ীর। স্কুল-কলেজ-মাদরাসা সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এসব পরিবার গ্রামে ফিরে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন তিনি।
শহরের ডায়াবেটিস হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা আসাদুল হক বলেন, তার এলাকায় অনেক পরিবার বাসা ছেড়ে গ্রামে চলে গেছেন। কিছু বাড়ির মালিক বাসা ভাড়া কমিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির মালিকরা চাচ্ছেন ভাড়া কম দিয়ে হলেও ভাড়াটিয়ারা থাকুক।
আলমডাঙ্গা পৌরসভার বাসিন্দা সহকারী অধ্যাপক রুহুল আমিন বলেন, ‘গত দুই মাসে তার এলাকায় অর্ধ শতাধিক পরিবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ থেকে বাসা গুটিয়ে চলে এসেছেন। তিনি আরও জানান, এসব পরিবার অর্থকষ্টে বড়শহর ছেড়েছেন। পরিস্থিতি ঠিক হলে তারা ফের শহরে ফিরে যাবেন বলেও জানান তিনি।