স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় আরও ৮৪জন করোনা ভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত হওয়ার আগেই উপসর্গ নিয়ে চুয়াডাঙ্গায় একের পর এক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে মারা গেলে ন্যূনতম স্বাস্থ্যবিধি মেনে দাফন কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে না। পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়স্বজন প্রতিবেশীর ভিড় জমছে। এ থেকেও ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ছাড়াচ্ছে বলে স্বাস্থ্য সচেতন অনেকেরই অভিমত। গতরাতে শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়ে ২ জন চুয়াডাঙ্গায় উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ১০ জন। এদের মধ্যে ৭ জন নিজবাড়িতে, ৪জন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। ৪ জনের মধ্যে একজনের বাড়ি মেহেরপুর বাড়াদীর পাটকেলপোতায়।
চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ গতকাল রোববার নতুন ২৭৯ জনের নমুনা নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় মোট নমুনা নেয়া হয়েছে ১৩ হাজার ২শ ৭৩ জনের। গতকাল ২২৫ জনের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট এসেছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানালেও পিসিআর ল্যাব থেকে পাওয়া গেছে মাত্র ৩১ জনের। এর মধ্যে ৩ জনের কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়েছে। তিনজনেরই ঠিকানা দেয়া আছে দর্শনা রেলবাজার। এদিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তথ্য দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, এন্টিজেনসহ ২২৫ জনের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৮৪ জনের পজিটিভ হয়েছে। যার মধ্যে সদর উপজেলার ১৮ জন, আলমডাঙ্গা উপজেলার ১২ জন, দামুড়হুদা উপজেলার ২১ জন ও জীবননগর উপজেলার ৩৩ জন। নতুন ৮৪ জনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে গতকাল রোববার চুয়াডাঙ্গা জেলায় করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১০ জন। এদের মধ্যে চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের মহিলা কলেজপাড়ার আমিনুল ইসলামের স্ত্রী তহুরা খাতুন বেশ কিছুদিন ধরে সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছিলেন। এক পর্যায়ে শ^াসকষ্ট বেড়ে যায়। গতকাল রোববার সকালে মারা যান ৫৫ বছর বয়সী তহুরা খাতুন। শহরের পোস্ট অফিসপাড়ার মৃত নূরুল হুদার ছেলে নাসির উদ্দিন সর্দি কাশিসহ গায়ে ব্যথায় ভুগছিলেন। বাড়িতেই ছিলেন তিনি। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে মারা যান ৫৫ বছর বয়সী নাসির উদ্দীন। তিনি শারীরিক প্রতবন্ধী ছিলেন। একটি পা না থাকলেও তিনি জীবন সংগ্রামে হারেননি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করতেন তিনি। অবশেষে করোনা উপসর্গ নিয়ে অজান্তেই হেরে গেলেন তিনি। তার মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে পরিচিতদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে। জেলা শহরের গুলশানপাড়ার নূরুল হক খেদুর প্রথম স্ত্রী কমেলা খাতুন বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মারা যান আনুমানিক ৬৪ বছর বয়সী কমেলা খাতুন। তিনিও করোনা উপসর্গে ভুগছিলেন বলে প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন। অপরদিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের হলুদ জোনে ভর্তি অবস্থায় করোনা উপসর্গ নিয়ে জীবননগর উপজেলার সন্তোষপুর গ্রামের মৃত মোশা করিমের ছেলে জোয়ান ম-র মারা গেছেন শনিবার দিনগত রাত ২টার দিকে। তিনি চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে শনিবার বিকেলে সর্দি কাশি জ¦র ও প্রচ- শ^াসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হন। তার বয়স হয়েছিলো ৬৫ বছর। জীবননগর উপজেলার বাঁকা গ্রামের লুৎফর রহমান (৮০) করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গতকাল রোববার খুলনা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। আলমডাঙ্গা উপজেলার হাড়োকান্দি গ্রামের মৃত আব্দুস সাত্তারের স্ত্রী সাহেদা খাতুন সর্দি কাশি জ¦রে ভুগছিলেন। তার নমুনা পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ পজিটিভ হয়। গতকাল রোববার ভোররাতে তিনি হাসপাতালের রেডজোনে মারা যান। আনুমানিক ৬০ বছর বয়সী সাহেদা খাতুনকে ২১ জুন চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। দামুড়হুদা উপজেলা সদরের মজিবর রহমানের স্ত্রী ডলি খাতুন রোববার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনিও সর্দি কাশি জ¦রে ও শ^াসকষ্টে ভুগছিলেন। গতকালই বিকেলে আনুমানিক ৪৫ বছর বয়সী ডলি খাতুন মারা যান। মেহেরপুর জেলার বারাদী পাটকেলপোতার মৃত রুহুল আমিনের ছেলে হুমায়ুন কবিরকে গতরাত ৮টার দিকে শ^াসকষ্ট জনিত সমস্যা নিয়ে হলুদ জোনে ভর্তি করা হয়। আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. ফাতেহ আকরাম দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন। সার্বক্ষণিক পাশে থেকে চিকিৎসা দিয়েও শেষ পর্যন্ত তাকে বাঁচাতে পারেননি। রাত সাড়ে ১০টার দিকে মারা যান হুমায়ুন কবির। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আনুমানিক ৫০ বছর বয়সী হুমায়ুন কবির বেশ কিছুদিন ধরে সর্দি কাশিতে ভুগছিলেন। শ^াসকষ্ট বেড়ে গেলে নেয়া হয় চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে। অবশেষে মারা গেলেন তিনি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা শহরের প্রায় প্রতিটি মহল্লায়, শহরতলি দৌলাতদিয়াড়ের কয়েকটি পাড়ায়সহ দামুড়হুদা ও জীবননগরের বেশ কিছু গ্রামে গণহারে সর্দি কাশি জ¦রে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। এদের অধিকাংশকেই করোনা পরীক্ষা করানোর বিষয়ে ন্যূনতম আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এদেরই কেউ কেউ যখন প্রচ- শ^াসকষ্টে ভুগতে শুরু করছেন তখনই তাদের পরিবারের সদস্যদের কেউ কেউ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। উপসর্গ নিয়ে ভর্তি করা হচ্ছে হাসপাতালের হলুদ জোনে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেয়ার আগেই অনেকে মারা যান। সংশ্লিষ্ট এরকমই তথ্য দিয়ে বলেছেন, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের রেডজোনে ভর্তি ৫৭ জনের চেয়ে হলুদ জোনে ৬৫ জনের অবস্থাই বেশি শংকটাপন্ন। অবাক হলেও সত্য যে, হলুদ জোনে যাদের ভর্তি করা হচ্ছে তাদের মধ্যে অনেকেই আবার হাসপাতাল কম্পাউন্ডের চা দোকানে গিয়ে চাপান করছেন। গল্পেও মাতছেন। এদিকে চুয়াডাঙ্গা পৌরসভা ও শহরতলি দৌলাতদিয়াড়ে লকডাউন চলছে। কয়েকদিন ঢিলেঢালা লকডাউন হলেও গতকাল রোববার দুপুর থেকে কঠোরভাবে পালনে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের তৎপরতায় বেড়েছে। ফলে বিকেল থেকে জেলা শহরের রাস্তায় ও বিপনী বিতানগুলো এলাকায় লোক সমাগম ছিলো না বললেই চলে। ওপর দিকে দামুড়হুদা ও জীবননগরেও কঠোর লকডাউন চলছে। এ দুটি উপজেলা নির্বাহী আফিসারসহ দুটি উপজেরার ৩টি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সাথে দায়িত্বশীলতার কারণে রাস্তায় লকসমাগম অনেকটাই কম পরিলক্ষিত হয়েছে।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, করোনার উপসর্গ নিয়ে আলমডাঙ্গায় একইদিনে এক নারীসহ ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন আলমডাঙ্গা পৌর এলাকার স্টেশনপাড়ার মৃত আজিজুল মেম্বারের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মামুন (৩০) গত ১ সপ্তাহ যাবত সর্দিজ্বরসহ করোনার উপসর্গ নিয়ে বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার শারীরিক অবস্থা শঙ্কটজনক হলে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেয়ার উদ্দেশ্যে গতকাল তাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। গতকাল রোববার দুপুর ২টায় তিনি মারা গেছেন। বেশ কয়েক দিন সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন আলমডাঙ্গার কালিদাসপুর ইউনিয়নের ডম্বলপুর গ্রামের খুশলালের ছেলে তাইজেল হোসেন (৫৫)। তিনি বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। গতকাল রোববার সকালে তিনি করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। নগরবোয়ালিয়া গ্রামের মৃত সমীর উদ্দীনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম (৬০) সম্প্রতি সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। বাড়িতে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। অবশেষে গতকাল রোববার সকালে করোনার উপসর্গ নিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আলমডাঙ্গার নওদাপাড়ার প্রবাসী খোকন আহমেদের স্ত্রী রিনা আহমেদ (৩৬) সম্প্রতি সর্দিজ্বর ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। বাড়িতেই চিকিৎসাধীন ছিলেন কয়েক দিন। শেষে তার অবস্থা শঙ্কাপন্ন হলে গতপরশু মেহেরপুরে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গতকাল রোববার সকালে করোনার উপসর্গ নিয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।