শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে রুশ সেনাবাহিনী : হাজার হাজার বেসামরিক লোকের যুদ্ধে যোগ
মাথাভাঙ্গা মনিটর: ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের তৃতীয় দিনে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে দেশটির সেনাবাহিনী। গতকাল শনিবার সকাল থেকে রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে রাস্তায় রাস্তায় তুমুল লড়াই শুরু হয়েছে। কিছুক্ষণ পর পর গুলি আর বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ইউক্রেন সেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন হাজার হাজার বেসামরিক লোক। ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, যুদ্ধে এ পর্যন্ত ১৯৮ জন নিহত এবং দেড় হাজারের বেশি আহত হয়েছেন। রাশিয়া দাবি করেছে, তারা মেলিটপোল শহর দখল করে নিয়েছে। অন্যদিকে ইউক্রেন সেনাদের দাবি, রাশিয়ার সাড়ে ৩ হাজার সেনাকে হত্যা এবং ২০০ জনকে বন্দি করেছে তারা। পেন্টাগন কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, আগ্রাসী অভিযান শুরুর পর রাশিয়ার কিছুটা গতি কমেছে। কারণ সীমান্তে ঢুকে পড়া যত সহজ, শহর দখল ততটাই কঠিন। তবে ক্ষণে ক্ষণে যুদ্ধের পরিস্থিতি পালটাচ্ছে বলেও সতর্ক করেছেন তারা।
এদিকে দুই পক্ষের কাছ থেকে আলোচনা ও অস্ত্রবিরতির খবরও পাওয়া যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, এক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করতে পারে ইসরাইল। দেশটিতেই দুই পক্ষ আলোচনায় বসতে পারে। তবে আত্মসমর্পণের গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেন, আমরা পালিয়ে যাইনি। অস্ত্রও ছাড়িনি। দেশকে রক্ষা করব আমরা। ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ ২৮টি দেশ।
সকাল থেকে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নানা প্রান্ত থেকে বিস্ফোরণ আর গোলাগুলির শব্দ ভেসে আসে। কিয়েভের ত্রোইয়েশনিয়া ও ময়দান স্কয়ারের কাছে সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ হয়েছে। এরপর সারা দিনই এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কিয়েভে রাশিয়ার কামান হামলার শব্দ এত বেশি যে, শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে কয়েক মাইল দূরেও শব্দ শোনা যাচ্ছে। শহরের চিড়িয়াখানা ও শুলিভাকা এলাকায় অর্ধশতাধিক বিস্ফোরণ হয়েছে। কিয়েভের পেরেমোহি অ্যাভিনিউয়ে গাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং বিভিন্ন জায়গায় আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। ভাসিলকিভের একটি বিমানঘাঁটির কাছে প্রচ- লড়াই হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, রুশ সেনারা কিয়েভে হামলায় এই ঘাঁটি ব্যবহারের চেষ্টা করছে।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দাবি করে, কৃষ্ণসাগর উপকূলীয় শহর মাইকোলাইভ থেকে রাশিয়ান সেনাদের সফলভাবে তাড়িয়ে দিয়েছে তারা। ইউক্রেনের স্টেট স্পেশাল সার্ভিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কিয়েভে ত্রোইয়েশনিয়া জেলায় সিএইচপি-৬ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছে দুই পক্ষের সেনাদের লড়াই চলছে। রাশিয়ার সেনারা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ করে দিয়ে রাজধানী কিয়েভ অচল করে দেওয়ার লক্ষ্যে সেখানে এমন হামলা চালাচ্ছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
তারা আরও জানায়, রাজধানী কিয়েভে একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। তবে তারা সেটি প্রতিহত করেছে। তারা আরও বলেছে, ওডেসা বন্দরের কাছে বাণিজ্যিক দুটি জাহাজে রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি-ভিডিওতে দেখা যায়-দুপক্ষের সেনারা অস্ত্র তাক করে সতর্ক অবস্থানে আছেন। কোথাও রুশ বাহিনীর গোলায় বিধ্বস্ত ভবনে চলছে উদ্ধার তৎপরতা। অস্ত্র হাতে লড়াইয়ে নেমেছেন বাসিন্দারা। একটি শহরে রুশ সেনার সঙ্গে এক নারীকে তর্ক করতেও দেখা যায়। ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, চলন্ত প্রাইভেট কার পিষে দিচ্ছে একটি রুশ ট্যাংক।
রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের দক্ষিণের জাপোরিঝঝায় অঞ্চলের মেলিটপোল শহর দখল করেছে। মেলিটপোল দেশটির একটি মাঝারি আকারের শহর। ইউক্রেনের প্রধান বন্দরগুলোর একটি মারিওপোলের কাছেই মেলিটপোলের অবস্থান। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যায় রাশিয়ার সেনাদের একটি দল কোনো প্রতিরোধ ছাড়া মেলিটপোলে ঢোকে। শহরে টহলরত রুশ সেনাদের স্বাগত জানায় বাসিন্দারা। প্রাপ্তবয়স্ক অনেকে লাল পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামেন।
ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী তাদের ফেসবুক পেজে দাবি করে, তারা আগ্রাসনে জড়িত ৩ হাজার ৫০০ রুশ সেনাকে হত্যা এবং প্রায় ২০০ জনকে বন্দি করেছে। এছাড়া এ পর্যন্ত রাশিয়া ১৪টি যুদ্ধবিমান, ৮টি হেলিকপ্টার ও ১০২টি ট্যাংক হারিয়েছে। বৃহস্পতিবার ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর এখন পর্যন্ত নিজেদের কত সেনা হতাহত হয়েছে, সে সম্পর্কে রাশিয়া এখনো কিছুই জানায়নি।
শুক্রবার থেকে গুঞ্জন উঠতে শুরু করে, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি রাশিয়ার সেনাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। শনিবার টুইটারে একটি ভিডিওতে এমন গুজব উড়িয়ে দিয়েছেন তিনি। ভিডিওতে দেখা যায়, কিয়েভের রাস্তায় সাদামাটা পোশাকে হাঁটছেন জেলেনস্কি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বাসভবন গরোদেৎস্কি হাউজের সামনের ওই ভিডিওতে জেলেনস্কিকে বলতে শোনা যায়, ‘অনলাইনে অনেক ভুয়া তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে, আমি নাকি সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দিয়েছি এবং নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছি। কিন্তু আমি এখানেই আছি। আমরা অস্ত্র ছাড়ব না। দেশকে রক্ষা করব।’
ইউক্রেনে রুশ সামরিক অভিযান শুরুর পর ন্যাটো জোটের অংশ হিসাবে ইউক্রেন সীমান্ত লাগোয়া রোমানিয়ায় ৫০০ সৈন্য মোতায়েনের ঘোষণা দিয়েছে ফ্রান্স। শুক্রবার ফ্রান্সের সেনাপ্রধান থিয়েরে বুরখারদ দেশটির সংবাদমাধ্যমের কাছে এ তথ্য জানান। বুরখারদ বলেন, কৌশলগত সার্বভৌমত্বের বিষয়টি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য রোমানিয়ায় অবস্থানরত সৈন্যের সংখ্যা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাটো।
রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্রবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত আছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। আলোচনার জন্য সম্ভাব্য তারিখ ও ভেন্যু ঠিক করা নিয়ে ক্রেমলিনের সঙ্গে কথা বলছে কিয়েভ। স্থানীয় সময় শনিবার এক ফেসবুক পোস্টে জেলেনস্কির মুখপাত্র সের্গি নিকিফোরভ বলেন, ‘আমরা আলোচনায় অস্বীকৃতি জানিয়েছি বলে যে দাবি করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। অস্ত্রবিরতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আলোচনায় ইউক্রেন আগেও প্রস্তুত ছিল, এখনো আছে।’ নিকিফোরভ আরও দাবি করেন, আলোচনার তারিখ ও ভেন্যু নির্ধারণ নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে আলাপ চলছে। ইসরাইলে নিয়োজিত ইউক্রেনের দূত ইউজিন করনিচাক আভাস দিয়েছেন, ক্রেমলিনের সঙ্গে কিয়েভের আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে পারে তেল আবিব। নিউইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, ‘তারা (ইসরাইল) না বলেনি। তারা বোঝার চেষ্টা করছে যে দাবার বোর্ডে তাদের অবস্থানটা কোথায়। আমরা বিশ্বাস করি, এ বিশ্বে ইসরাইলই একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ, যার সঙ্গে ইউক্রেন ও রাশিয়া দুই দেশেরই দারুণ সম্পর্ক রয়েছে।’
রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেনসহ ২৮ দেশ। এছাড়াও চিকিৎসা সরঞ্জামাদি ও অন্যান্য মিলিটারি সহায়তা দেবে দেশগুলো। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইউক্রেনকে জরুরি অস্ত্র সহায়তা দিতে একটি ৬০০ মিলিয়ন ডলারের স্মারকে সই করেছেন। এতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনকে কোনো ধরনের আইনের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই জরুরি ভিত্তিতে ইউক্রেনকে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বাইডেন। বাকি ৩৫০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র সহায়তা প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রতিরক্ষা আইনের ধারা ও সেবার অধীনে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পেন্টাগন কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকরা বলছেন, মাথার ওপরে থাকা যুদ্ধবিমানের সুরক্ষা আর ট্যাংক-কামান নিয়ে অন্য দেশের সীমান্তে ঢুকে পড়া যত সহজ, শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেয়া এবং জীবন দিতে প্রস্তুত লোকজনের সমন্বয়ে গঠিত সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করা ততটাই কঠিন। রাশিয়ার সামরিক বাহিনী ইউক্রেনে সর্বাত্মক যুদ্ধে নামার পর খুব দ্রুতই যুদ্ধের কঠিন অংশটুকু সামনে চলে আসায় তাদের গতি কমেছে। রাশিয়া এখনো জনবহুল কোনো শহর দখলে নিতে পারেনি বলেও জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।