স্টাফ রিপোর্টার: কয়েন কেনা বেচার নাটক সাজিয়ে কয়েক কোটি টাকা প্রতারণার মামলায় গ্রেফতারকৃত চুয়াডাঙ্গা জীবননগরের আবু তাহের জবা ও তার দু’সহযোগীকে ঝিনাইদহ থেকে মাগুরা জেলহাজতে নেয়া হয়েছে। অপরদিকে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঝিনাইদহ পিবিআইয়ের এসআই তৌহিদুল ইসলাম মামলার এক আসামির স্ত্রীর সাথে বলা কথপোকথনের রেকর্ড ফাঁস হওয়ায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, উদ্ধারকৃত টাকার পরিমাণ নিয়ে।
জানা গেছে, দেশে কিছু কয়েন রয়েছে, যা আমেরিকার একটি প্রতিষ্ঠান মোটাঅংকের ডলারের বিনিময়ে ক্রয় করে বলে দেশের একটি প্রতারকচক্র নাটক সাজায়। নিজেদের মধ্যেই ক্রেতা-বিক্রেতা সেজে আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যানের ব্যাংক হিসেব থেকে তোলা দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় বলে অভিযোগ ওঠে। মামলা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশের একজনের কাছে একটি মূল্যবান কয়েন আছে। যা নাসা গবেষণা কাজে ব্যবহার হয়। একজন আমেরিকান ক্রেতা আছে যিনি ওই কয়েন ক্রয় করবেন। কিন্তু সরাসরি আমেরিকানরা ওই কয়েন ক্রয় করতে পারে না। তাই আপনার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করা সম্ভব। কয়েনের মূল্য ১ হাজার ২শ কোটি টাকা। এরপর আনন্দ গ্রুপের চেয়ারম্যান ড. বারীর ব্যাংক একাউন্ট থেকে উত্তোলন করা নগদ দেড় কোটি টাকা বাদীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় প্রতারকরা। চক্রের সাথে দুইজন গার্মেন্টস ও প্রতিষ্ঠিত কাপড় ব্যবসায়ী রয়েছেন। এদিকে আসামিদের মধ্যে ঝিনাইদহ আরাপপুর মাস্টারপাড়ার আক্তারুজ্জামান লিটন, বরিশাল বাবুগঞ্জের মাধবপাশা গ্রামের মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান ও চুয়াডাঙ্গা জীবননগরের বালিহুদা গ্রামের আবু তাহের জবাকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর তারা ঝিনাইদহ জেলহাজতে ছিলো। পরে জামিন পায়। পরবর্তিতে মাগুরায় দায়েরকৃত মামলায় শোন এরেস্ট দেখানো হয়। এ মামলায় তিনজনকে মাগুরা জেলহাজতে নেয়া হয়েছে। অপরদিকে তদন্তকারী অফিসার এসআই তৌহিদুল ইসলাম মামলার আসামিদের একজনের স্ত্রীর সাথে যে কথা বলেছেন, তার অডিও রেকর্ড ঝিনাইদহের সাংবাদিকদের হাতে পৌঁছে গেছে। এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় বলা হয়েছে, যে রেকর্ড করা হয়েছে তাতে আসামির কথিত সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে এসআই তৌহিদ বলেছেন, আপনি কো-অপারেট করেন, যে ভাই আমি এটা দিচ্ছি, আমি সেটা ইয়ে করবো, আপনি যদি দায়িত্ব পালন করেন, তাহলে পরবর্তীতে তাকে (ওই নারীর স্বামী) মামলা থেকে বাঁচানোর জন্য আমি যা করার সবই করবো।
নগদ ১৫ লাখ টাকা জব্দ তালিকায় ইচ্ছে করলে নিতে পারতাম মর্মেও ওই নারীকে বলেন এসআই তৌহিদ। কয়েক দফায় কথা বলেছেন তারা। সেই সূত্রে বেরিয়ে পড়েছে আরও অনেক তথ্য। যা সম্পূর্ণ প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
মাগুরা থানা পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ১০ ফেব্রুয়ারি মাগুরা মুহাম্মদপুর থানার মোবারেকপুর গ্রামের মৃত রাখাল সরকারের ছেলে রমেশ সরকার (৪২) একটি মামলা দায়ের করেন। প্রাথমিকভাবে এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় ওই থানার এসআই (নিরস্ত্র) মো. আনিছুর রহমানকে। সূত্র মতে, পরবর্তী সময়ে ৬ মার্চ তদন্তভার গ্রহণ করেন ঝিনাইদহ পিবিআইয়ের এসআই চন্দ্র শেখর পাল। এর আগে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি ঢাকার আনন্দ গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক এএইচএম মাহবুব আলাম সরকার ঝিনাইদহ থানায় দুইজনের নাম উল্লেখ করে দেড় কোটি টাকার কয়েন প্রতারণার অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের করেন। ঝিনাইদহ থানায় দায়ের করা মামলাটি পুলিশের কাছ থেকে তদন্তভার পিবিআই ঝিনাইদহের এসআই মো. তৌহিদুল ইসলামকে দেয়া হয়। উল্লেখিত তিন আসামিসহ ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয় মর্মে আদালতকে অবহিত করেন তিনি। অভিযোগ করা হয়েছে বিপুল অংকের নগদ টাকা উদ্ধারের বিষয়টি বেমালুম চেপে যান তদন্তকারী কর্মকর্তা। অভিযানের সময় আসামি মো. আবু তাহের জবা, মো. মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, আক্তারুজ্জামান আক্তার ওরফে সালাম, মো. শফিকুল ইমলাম স্বপন ও মো. স্বপন ব্যাপারীকে আটক করা হয়। তাদের কাছ থেকে কয়েনসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি, পাসপোর্ট, মোবাইল, সিম কার্ড, চেক বই এবং বিপুল অংকের নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়। কিন্তু আদালতে জমা দেয়া জব্দ তালিকায় নগদ টাকা হিসেবে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৫০ টাকা উদ্ধার দেখানো হয়। পাশাপাশি আসামি গ্রেফতারের চার দিন পরে আদালতে পাঠানোর বিষয়টি নজরে আনেন আসামি পক্ষের আইনজীবীরা। ঝিনাইদহ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এক আদেশে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মো. তৌহিদুল ইসলামকে সশরীরে হাজির হয়ে ৭দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর জন্য আদেশ দেন। আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে ঝিনাইদহ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ক্রিমিনাল রিভিশন করেন এসআই তৌহিদ। অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ দ্বিতীয় আদালতের বিচারক শুনানি শেষে তার ওই আবেদন নামঞ্জুর করেন। শেষ পর্যন্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আদেশ পালন করেন এসআই তৌহিদ। আদালতের আদেশেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তার পরিবর্তন ঘটে।
এদিকে ৪ মার্চ আমলি আদালত ঝিনাইদহ সদরের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এমএ আজহারুল ইসলাম মো. মনিরুজ্জামান কামরুল ওরফে জামান, মো. শফিকুল ইসলাম স্বপন, এবং মো. স্বপন ব্যাপারীকে অন্তবর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু কারাগার থেকে বের হতে পারলেন না তারা। উদ্ধার করা পাসপোর্টের সূত্র ধরে মাগুরা থানায় দায়ের করা চার লাখ টাকা প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগের (অন্য একটি) মামলায় শ্যোন অ্যারেস্ট করা হয় তাদের।
জানা গেছে, পিবিআই যে কয়টি পাসপোর্ট জব্দ করেছে তার মধ্যে মাগুরা থানায় দায়ের করা ওই মামলার বাদী রমেশ সরকারেরটি রয়েছে। ঝিনাইদহ পিবিআইয়ের পরিদর্শক (প্রশাসন) মোহা. আবদুর রব (নিরস্ত্র) সোমবার জানান, দুইজন আসামিকে একদিন করে এবং সবাইকে ঝিনাইদহ জেলা কারাগারের গেটে একদিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।