কাজ শেষে গোল হয়ে বসে টাকা ভাগ করা পুরোন রেওয়াজ : সুবিধাও অনেক
আনোয়ার হোসেন: কাজ শেষে বাড়ি ফেরার আগে গোল হয়ে বসে অর্জিত অর্থ ভাগ বাটা করেন কারা? হাট বাজারের এরা চেনা মুখ। হাঁড় ভাঙা পরিশ্রম হলেও প্রতিদিনই পরম তৃপ্তি নিয়ে কাজ করেন। আয়ের টাকা নিয়ে খুশি মনেই বাড়ি ফেরেন। মাথায় করে বস্তা বহন করতে কষ্ট হয় না? কেনোই বা এই পেশায় আসতে হয়েছে? এসব প্রশ্ন নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষগুলোর সামনে গেলে তারা তাদের কাজকে খাটো করে দেখতে না চাইলেও অধিকাংশই পাল্টা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, শখ করে কি কেউ হাঁড়ভাঙা খাটুনির কাজ করে?
অভাব কেনো? জন্মগত নাকি পরিবারের কারো সুস্থ করতে সর্বস্ব হারিয়ে হতে হয়েছে নিরুপায়? নাকি হাট বাজারে ভারি বস্তাবহনের কাজ পূর্বপুরুষের থেকে পাওয়া? এসব প্রশ্নের রকমারি জবাব দেয়ার আগে গোল হয়ে বসে টাকা ভাগ করার বিষয়টি বিষদে ব্যখা করলেন কয়েকজন। চুয়াডাঙ্গা গমপট্টি কালক্রমে এখন চালপট্টি হিসেবেই পরিচিতি পাচ্ছে। পাশেই স্টেশন। স্টেশনের কুলিদের অবশ্য এখন আর আগের মতো জৌলুস নেই। এরাও দিন শেষে গোল হয়ে বসেই আয়ের টাকা ভাগ করেন। চালপট্টির কয়েকজন গোল হয়ে টাকা ভাগ করার বিষয়ে বললেন, ‘আমাদের এই পেশা অনেক পুরোনো। প্রথম দিকে হয়তো অনেকে টাকা গোনার হিসেবে অতোটা পাঁকা ছিলেন না। কড়ি কিম্বা আনার যুগ গত হওয়ার অনেক পরে যখন টাকা এসেছে তখনও এক কুড়ি দু কুড়ি করে গুনতেন। তখন থেকেই গোল হয়ে বসে টাকা ভাগ করার রেওয়াজ। সুবিধাও অনেক। সেই রেওয়াজ অনুযায়ী এখনও আমরা প্রথমে বড় নোটগুলো সমান করে ভাগ করি, এরপর ছোট নোট। এতে টাকা ভাগ করা যেমন সহজ হয়, তেমনই কেউ একাই সব মোটা নোট বা ছোট নোট পান না, একসাথে সকলেই সমান পরিশ্রম করতে হয়, বাড়ি ফেরার আগে সমপরিমাণ টাকাই শুধু নয়, সমান সমান টাকার নোট নিয়ে বাজার করে বাড়ি ফেরার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে আনন্দ। ঘাম ঝরিয়ে আয়ের টাকা যারা অপচয় করেন কিম্বা ফালতু খরচের পথে পা বাড়ান তাদের কথা আলাদা।’
কতোজন থাকে দলে? ঠিক নেই। তবে কাজ বুঝে লোকের সংখ্যা কম বেশি হয়। যেখানে কাজ বেশি সেখানে লোকবলও বেশি। যেখানে কাজ কম সেখানে স্বাভাবিকভাবে লোকবলও কম রাখতে হয়। চালপট্টিতে ৭/৮ জন মিলে-মিশে কাজ করেন। প্রতিদিন ৫শ সাড়ে ৫শ টাকার ভাগ নিয়ে বাড়ি ফেরেন প্রত্যেকে। সরোজগঞ্জের মতো হাট বাজারে লোকবলও বেশি, আয়ও তুলনামূলক বেশি হয়। তা না হয় হলো, বোঝা বহনের মতো কাজে আসতে হলো কেনো? নানা জনের নানা মত। সকলেরই অভিন্ন বক্তব্য- হাত পেতে নয়, কাজ করে খাওয়ার তৃপ্তিই আমাদের শক্তি জোগায়। তবে একেক জনের একেক রকমের সমস্যার কারণে দারিদ্র্যের কষাঘাতে পড়তে হয়েছে। কোনোকাজই যেহেতু ছোট নয়, সেহেতু লেবারের কাজ বেছে নিলেও তারা যে বেকার নয় এতেই খুশি সকলে। আব্বাস আলী বললেন, গ্রামের স্কুলে ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। পিতাকেও এই কাজ করতে হয়েছে। আব্বা হয়তো আমাকে অন্য পেশায় দেখতে চেয়েছিলেন। অভাব শেষ পর্যন্ত তা আর হতে দেয়নি। আব্দুস সালামের অবশ্য ভিন্নমত। তিনি বললেন, শিশুকালে লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি। কৃষি কাজ দিয়ে কর্মজীবন শুরু। পরে বাধ্য হয়েই এই কাজে যোগ দিয়ে ৫ বছর ধরে বেশ ভালোই রয়েছি। আব্দুল মজিদ বললেন, বাবা চাষ করতেন। জমি ছিলো সামান্য। পরে তাতে আর আমাদের চলেনি। এই কাজ জুটিয়ে নিতে হয়েছে। অনেকের তুলনায় ভালোই আছি। আব্দুল আজিজ বললেন, পিতার থেকে পাওয়া এই কাজ টানা ৩০ বছর ধরে করছি। ঝণ্টু মিয়ার পিতা ছিলেন চাষি। আবাদে মন্দা। জমিও হলো হাতছাড়া। উপায় না পেয়ে এই কাজ করছেন বলে জানালেন তিনি।
সমাজের পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলোর সন্তান হয়ে যাদেরকে হাট বাজারে কুলি মুটে বা লেবারের কাজ করতে হচ্ছে তাদের প্রত্যেকেরই অভিন্ন উক্তি, ‘অভাব অনেককে বিপথগামীও করে। আমরা কাজ করে সংসার চালাচ্ছি। সন্তানেরা যাতে ভালো থাকে সে চেষ্টাও করছি।’ অধিকাংশেরই স্বপ্ন, তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করা। কারও কারও স্বপ্ন ভেঙে গেছে, ছেলেকে শিশুকালেই লাগাতে হয়েছে কাজে, কারও কারও স্বপ্ন এখনও জিইয়ে রয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য স্বপ্ন বাস্তবায়নের দারপ্রান্তে।