রহমান মুকুল: উপমহাদেশের প্রথম রেললাইনের ঐতিহ্যের স্মারক লালব্রিজ যেনো আলমডাঙ্গাবাসীর চোখের জলে পরিণত না হয় সে ব্যাপারে এখনই পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি উচ্চকিত হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছরই আলমডাঙ্গা লালব্রিজ বা রেলব্রিজ কেন্দ্রীক দুর্ঘটনায় ঝরে পড়ছে তরতাজা প্রাণ। তবে গত ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল লালব্রিজ দেখতে গিয়ে ট্রেনে কেটে দুই ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনায় এ দাবিকে যৌক্তিক ভাবতে শুরু করেছে সচেতনমহল।
জানা যায়, ১৮৫৪ সালে ভারতের তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড ডালহৌসির বৃষ্টিস ভারতে রেললাইন স্থাপনের নির্দেশ দেন। কিছুটা বিলম্ব হলেও তার নির্দেশে বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬২ সালে। মূলতঃ বাংলাদেশে রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর থেকে। ওই সময় চুয়াডাঙ্গা জেলার দর্শনা হতে কুষ্টিয়া জেলার জগতি পর্যন্ত ৫৩.১১ কিলোমিটার লাইন স্থাপিত হয়। নীলকরদের বিরুদ্ধে এতদাঞ্চলে প্রচন্ড কৃষক বিদ্রোহের কারণে বিতাড়িত কিছু নীলকর সাহেব জগতিতে আখ মাড়াইয়ের কল উৎপাদন শুরু করেছিলেন। ভারি ভারি আখ মাড়াইয়ের কল বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের নিকট পৌঁছানো সহজ হবে রেলপথে। এমন চিন্তা থেকেই কুষ্টিয়ার জগতিতে প্রাক্তন নীলকর সাহেবদের স্বার্থে ও প্রযতেœ অবহেলিত এ জনপদে অন্যান্য অঞ্চলের অগেই রেলের যাত্রারম্ভ। পরে ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি গোয়ালন্দ পর্যন্ত সেকশনটি চালু হয়। অবশ্য বাংলায় আরও প্রায় ৮ বছর পূর্বে প্রথম রেলপথ চালু হয় ১৮৫৪ সালে পশ্চিম বঙ্গের হাওড়া থেকে হুগলি পর্যন্ত ৩৮ কিলোমিটার রেলপথের উদ্বোধনের মাধ্যমে। ১৮৯৭ সালে দর্শনা পোড়াদহ সেকশনটি সিঙ্গেল লাইন থেকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়। পর্যায়ক্রমে ১৯০৯ সালে পোড়াদহ-ভেড়ামারা, ১৯১৫ সালে ভেড়ামারা-ঈশ্বরদী এবং ১৯৩২ সালে ঈশ্বরদী আব্দুলপুর সেকশনগুলোকে ডাবল লাইনে উন্নীত করা হয়।
জানা গেছে, আলমডাঙ্গায় কুমার নদের ওপর লালব্রিজখ্যাত বর্তমান রেলওয়ে ব্রিজটি ১৯০৯ সালে উদ্বোধন করা হয়। তারপর কালিদাসপুর থেকে রেলস্টেশন আলমডাঙ্গায় স্থানান্তরিত হয়। বাংলাদেশের রেলপথের ইতিহাসে আলমডাঙ্গা রেলওয়ের লালব্রিজটি রীতিমত ঐতিহ্যের স্মারক। ব্রিটিশ ভারতের বর্তমান বাংলাদেশ অঞ্চল সর্বপ্রথম রেললাইনের ওপর নির্মিত এটি। আলমডাঙ্গার লালব্রিজখ্যাত রেলওয়ে ব্রিজটিও প্রথম নির্মিত রেলওয়ে ব্রিজ। দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতী পর্যন্ত নির্মিত প্রথম রেললাইনের ওপর নির্মিত আলমডাঙ্গা লালব্রিজটি ইংরেজ শাসনামলের বিশিষ্ট স্থাপত্যও বটে। এটি রেলপথ নির্মাণের ইতিহাসে ঐতিহ্যের অন্যতম স্মারকও। ভেড়ামারা-ঈশ্বরদীর হার্ডিং ব্রিজেরও অনেক আগে নির্মিত আলমডাঙ্গা লালব্রিজ। এটি নিঃসন্দেহে আলমডাঙ্গা শহরের সৌন্দর্য অনেক বৃদ্ধি করেছে। এটি সবশেষ গর্বেরও।
অথচ, সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ না করার ফলে ঐতিহ্যের স্মারককে লালব্রিজ এখন আলমডাঙ্গা অঞ্চলের মানুষের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ফি বছর এ ব্রিজ কেন্দ্রীক ট্রেন দুর্ঘটনায় ঝরছে তরতাজা প্রাণ। গত ৫ মে কামালপুরের ৩ শিশু লালব্রিজে ঘুরতে যায়। সে সময় ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেসের ধাক্কায় হুসাইন নামের এক ১২ বছরের শিশুর মৃত্যু হয়। নীচে কুমার নদের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচায় বাকী দুই শিশু।
গত ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল নানাবাড়ি বেড়াতে এসে লালব্রিজে হাঁটতে গিয়ে ট্রেনে কেটে দুই চাচাতো ভাইর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। তাদের মধ্যে সুজন অনার্সের ও আরাফাত ২য় শ্রেণির ছাত্র ছিলো। তাদের বাড়ি চুয়াডাঙ্গা জেলার ডিঙ্গেদহ। আলমডাঙ্গা কালিদাসপুরে নানার মিলাদ মাহফিলে এসেছিলো দুই ভাই। দুপুরে মিলাদ মাহফিল শেষে অনার্স পড়ুয়া সুজন তার চাচাতো ভাই ২য় শ্রেণিতে পড়ুয়া আরাফাতকে নিয়ে নিকটবর্তী রেলব্রিজ দেখতে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সন্ধ্যার আগে তারা লালব্রিজের ওপর দিয়ে হেটে হেটে বাড়ি ফিরছিলো। হঠাত ওই সময় রাজশাহীগামী মহানন্দা এক্সপ্রেস ট্রেন আসতে দেখে তারা বিচলিত হয়ে পড়ে। ট্রেন দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে সুজন ছোট ভাই আরাফাতের হাত ধরে ধেয়ে আসা ট্রেনের সামনে সামনে রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াতে থাকে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ব্রিজের ঠিক মাথায় পৌঁছুতে না পৌঁছুতেই তারা দুর্ঘটনার শিকার হয়। দুজনই কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়। মাত্র ২-১ সেকেন্ডের জন্য তাদের প্রাণ দিতে হয় বলে প্রত্যক্ষদর্শীর অনেককে মন্তব্য করতে শোনা যায়।
এখন দাবি উঠেছে লালব্রিজ কেন্দ্রিক ট্রেন দুর্ঘটনা এড়াতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের। দাবিগুলোর অন্যতম হচ্ছে ১) লালব্রিজের দুই পাশে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি সংবলিত বিলবোর্ড স্থাপন (কোন লাইনের কোন দিক থেকে দ্রুত ট্রেন আসার আশঙ্কা রয়েছে তা কীভাবে বুঝতে পারবে তা লেখা থাকবে এবং সেখানে উল্লেখ থাকবে লালব্রিজে হাঁটার সময় ট্রেন চলে এলে কোথায় নিরাপদে দাঁড়াতে হবে)। ২) লালব্রিজে ট্রেন প্রবেশের পূর্বেই হুইসেল দিয়ে সতর্ককরণ করা। ৩) অটোমেটিক ডিজিটালাইজড ডোর স্থাপন। ৪) লালব্রিজের দুপাশে লোকবল নিয়োগ করা। মাঝে মধ্যেই লালব্রিজে তরতাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ায় এ দাবিগুলো উচ্চকিত হচ্ছে ক্রমেই।