স্টাফ রিপোর্টার: রোহিঙ্গা সংকটের তিন বছর পার হয়েছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর বর্বর নির্যাতনে দেশটি থেকে পালিয়ে এসেছিলো তারা। শুরুতে তাদের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন কথা বললেও বর্তমানে তারা তেমন কোনো কথা বলছে না। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করছে না মিয়ানমার। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক আইন, বিভিন্ন চুক্তি এবং বিশ্বনেতাদের দাবিসহ কোনো কিছুকেই আমলে নিচ্ছে না সেনা নিয়ন্ত্রিত দেশটি। নতুন করে আবার করোনার অজুহাত দেয়া হচ্ছে। ফলে রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় ধরনের চাপ ছাড়া এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেবে না দেশটি।
কনিবার রোহিঙ্গা সঙ্কট মোকাবেলা সংক্রান্ত একটি আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। যৌথভাবে কয়েকটি সংগঠন এই সেমিনারের আয়োজন করে। এগুলো হল- ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ রিসার্স ইনস্টিটিউট (বিআরআই), ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) এবং আসা ফিলিপিনস ফাউন্ডেশন অনটারিও অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি (ওআইডিএ)। এ সময় বক্তারা রোহিঙ্গাদের অধিকার রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কঠোর সমালোচনা করেন।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, কানাডার লরেন্টিয়ান ইউনিভার্সিটির ল ও জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপারসন ড. হেনরি পোলারড, অস্ট্রেলিয়ার সুইনবর্ন ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির প্রফেসর ক্রিস্টানা জব, সুইনবর্ন ইউনিভার্সিটির ড. মহসিন হাবিব, বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. শহিদুল হক, অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. সুফিউর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনোসাইড স্টাডিজ সেন্টারের পরিচালক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ এবং বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট টুন খিন প্রমুখ। এ সময় নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য আরাকানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের প্রস্তাব দেন কেউ কেউ।
সুফিউর রহমান বলেন, বর্বর নির্যাতনে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছে। ১০ হাজারের বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু নির্যাতিত এসব নাগরিকের অধিকার রক্ষায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে দেখা যায়নি। তিনি বলেন, নির্যাতনের পরও মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বারবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। সীমান্তে আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ধৈর্য ও দায়িত্বশীল আচরণ করেছে।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক বলেন, পৃথিবীর যে কোনো দেশেই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের নিশ্চয়তা জরুরি। সেটি দিতে ব্যর্থ হয়েছে মিয়ানমার। আর এই অন্যায়ের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন মহল থেকে নিরাপদ পরিবেশের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার না চাইলে নিরাপদ পরিবেশ সম্ভব নয়।
প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি চুক্তি হয়েছে। এসব চুক্তি বাস্তবায়নে বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা বাস্তবায়ন করছে না। তিনি বলেন, জেনেভা কনভেনশনসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন আইন রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার এগুলো আমলে নিচ্ছে না। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বড় ধরনের চাপ ছাড়া রোহিঙ্গাদের ফেরানো সম্ভব নয়।
অস্ট্রেলিয়ার ইন্টারন্যাশনাল ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট ডিন প্রফেসর নিকোল জিওরজিউ বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগ নিতে হবে। আসিয়ানের পক্ষ থেকেও কোনো একটি উদ্যোগ নেয়া যায়।
আরাকান রোহিঙ্গা ইউনিয়নের মহাপরিচালক ড. ওয়াকার বলেন, মিয়ানমার আর্মি হত্যা, ধর্ষণ এবং ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা তারা করেনি। এর কোনো বিচার হয়নি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন আলোচনা হলেও পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না। নতুন করে যুক্ত হয়েছে করোনা ইস্যু। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর উদ্যোগ নেয়া উচিত।
জার্মানির ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন অ্যান্ড বয়কট মিয়ানমার ক্যাম্পেইনের উদ্যোক্তা নেই সান লইন বলেন, নির্যাতনের তিন বছর পার হয়েছে। ইতিহাসের ন্যক্কারজনক বর্বর হত্যাকা- ঘটিয়েছে তারা। একটি দেশের দায়িত্ব কী, তা তারা ভুলে গেছে। ইতোমধ্যে দেশটির কর্মকা-ে মনে হয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক আইন ও পুরো পৃথিবীকে চ্যালেঞ্জ করছে।
অন্য বক্তারা বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন রোহিঙ্গাদের নিয়ে কী করতে চাচ্ছে, তা পরিষ্কার নয়। এ ব্যাপারে আগের চেয়ে তাদের কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে এসেছে। তারা বলেন, ৬ থেকে ৭ দশক পর্যন্ত রোহিঙ্গারা অংশ ছিলো। কিন্তু হঠাৎ তাদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হলো। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তাও কমেছে। গত তিন বছরে ২২ দেশ থেকে ৭২ কোটি ৭৮ লাখ ডলার সহায়তা এসেছে, যা মোট খরচের ৭০ শতাংশ। বাকি ৩০ শতাংশ বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য এটি বড় বোঝা।