স্টাফ রিপোর্টার: রাজধানীর আগারগাঁও, কচুক্ষেত ও উত্তরা এলাকায় তিনটি (র্যাবের দুটি এবং ডিজিএফআইয়ের একটি) ‘আয়নাঘর’ বা গোপন বন্দিশালা পরিদর্শন করলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার সকালে বন্দিশালা পরিদর্শন শেষে তিনি সঙ্গে থাকা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বীভৎস দৃশ্য। নৃশংস জিনিস হয়েছে এখানে। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলতে কোনো জিনিস আছে! যতোটাই শুনি মনে হয় অবিশ্বাস্য, এটা কী আমাদেরই জগৎ! আমাদের সমাজ! যারা নিগৃহীত হয়েছেন, তারাও আমাদের সমাজেই আছেন। তাদের মুখ থেকে শুনলাম। কী হয়েছে, কোনো ব্যাখ্যা নেই। ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার দেশে আইয়ামে জাহেলিয়া (অন্ধকার যুগ) প্রতিষ্ঠা করেছিল। এটা (আয়নাঘর) তার একটি নমুনা।’ প্রসঙ্গত, গুম করে এসব গোপন বন্দিশালায় মানুষকে আটকে রাখা হতো। এসব বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এবং স্থির ও ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, আয়নাঘরগুলোর বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখেন প্রধান উপদেষ্টা। সঙ্গে ছিলেন ছয় জন উপদেষ্টা, গুম কমিশনের প্রধানসহ পাঁচ জন সদস্য ও গুমের শিকার হওয়া আট জন ভুক্তভোগী। এছাড়াও ছিলেন বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও দুটি বিদেশি গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। পরিদর্শন শেষে অধ্যাপক ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের বিনা কারণে, বিনা দোষে উঠিয়ে আনা হতো। সন্ত্রাসী বা জঙ্গি বলে এখানে ঢুকিয়ে রাখা হতো। এরকম টর্চার সেল (নির্যাতনকেন্দ্র) সারা দেশে আছে। ধারণা ছিল, এখানে কয়েকটা আছে। এখন শুনছি বিভিন্ন ভার্সনে (সংস্করণে) দেশ জুড়ে আছে। সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি। তিনি বলেন, এ ধরনের ইন্টারোগেশন সেল, টর্চার সেল দেশ জুড়ে আছে, সেটা শুনলাম আজকে। কেউ বলছেন ৭০০, কেউ বলছেন ৮০০; সংখ্যাও নিরূপণ করা যায়নি, কতটা আছে। এর মধ্যে কতগুলো জানা আছে, কতগুলো অজানা। মানুষকে সামান্যতম মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ‘একজন বলছিলেন- খুপরির মধ্যে রাখা হয়েছে। এর থেকে তো মুরগির খাঁচাও বড় হয়। বছরের পর বছর এভাবে রাখা হয়েছে।’ সমাজকে এসব থেকে বের করে না আনা গেলে সমাজ টিকবে না—উল্লেখ করে তিনি বলেন, নতুন সমাজ গড়া, অপরাধীদের বিচার করা ও প্রমাণ রক্ষার ওপর আমাদের জোর দিতে হবে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ন্যায়বিচার যেন পায়, সেটাই এখন প্রাধান্য পাবে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন বাংলাদেশ ও নতুন পরিবেশ গড়তে চাই। সরকার সে লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন করেছে। যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, তার পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সরকার সে লক্ষ্যে কাজ করবে।’ প্রধান উপদেষ্টা প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেল এবং র্যাব-২ এর সিপিসি-৩ এর ভেতরের সেলগুলো পরিদর্শন করেন। পরে র্যাব সদর দপ্তরের টাস্কফোর্স ইন্টেলিজেন্স সেন্টারে যান। আয়নাঘর পরিদর্শনকালে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের ছেলে এবং গুমের শিকার হওয়া ব্রি. জে. (অব.) আব্দুল্লাহিল আমান আযমী; মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার আহমদ বিন কাসেম আরমানও ছিলেন এসময়। তারাসহ সঙ্গে থাকা গুমের শিকার আটজন কীভাবে আয়নাঘরে ছিলেন, কীভাবে তাদের দিন কাটত ও নির্যাতন চালানো হতো সেটির বর্ণনা দেন। ছোট্ট কক্ষে কীভাবে তাদের রাখা হয়েছিল তাও বর্ণনা করেন। এ সময় ভুক্তভোগীরা নির্যাতনের ভয়াবহতার প্রতীক হিসেবে কচুক্ষেত বন্দিশালার দেওয়ালগুলো দেখান। এছাড়া আগারগাঁও বন্দিশালায় একটি ইলেকট্রিক চেয়ার দেখানো হয় প্রধান উপদেষ্টাকে। শেখ হাসিনার শাসনামলে এসব গোপন বন্দিশালায় জিজ্ঞাসাবাদের নামে আটক ব্যক্তিদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালানো হতো।
প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনের বিষয়ে তুলে ধরতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমেতি আয়োজিত এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, গুম কমিশনের প্রতিবেদন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর তদন্তের ভিত্তিতে ধারণা করা যায়, সারা দেশে ৭০০-৮০০ আয়নাঘর আছে এবং এটা আরো বের হচ্ছে। তাতে বোঝা যাচ্ছে যে, এটি শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিল না, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এরকম আয়নাঘর ছিল। হিউম্যান রাইট ওয়াচের প্রতিবেদনে স্পষ্ট লেখা আছে গুম ও খুনের সঙ্গে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা জড়িত ছিল, তার নির্দেশেই এগুলো হয়েছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে প্রেস সচিব বলেন, কিছুদিন আগে রিপোর্ট হয়েছিল যে, আয়নাঘর পরিদর্শন হচ্ছে না। কিন্তু আপনারা দেখেছেন যে, ঢাকার কয়েকটি আয়নাঘর ভিজিট হয়েছে। বাংলাদেশে যত আয়নাঘর আছে, প্রত্যেকটা খুঁজে বের করা হবে।
তিনটি লোকেশনে ‘আয়নাঘর’ পরিদর্শন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে দুটো র্যাবের, আর একটি ডিজিএফআইয়ের। সেখানে কীভাবে রাখা হতো, নির্যাতন করা হতো, কীভাবে দিন কাটিয়েছেন, কেউ কেউ সেখানে সাত-আট বছর কাটিয়েছেন, তার বর্ণনা আসলে প্রকাশ করার মতো না। পরিদর্শনকালে এগুলো প্রকাশ পায়। প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটা স্পটে গিয়েছেন। সেখানে যারা বন্দি ছিলেন, তারা তাদের সঙ্গে হওয়া ঘটনাগুলো প্রধান উপদেষ্টাকে বর্ণনা করেন। শফিকুল আলম বলেন, আমরা সেখানে সবাইকে নিতে পারিনি, এজন্য আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আমরা বিটিভির মাধ্যমে সবগুলো ভিডিও করেছি। আমাদের সঙ্গে শুধু দুটি মিডিয়া আউটলেট ছিল। বিটিভি থেকে দুজন ক্যামেরাম্যান নিয়েছি, পিআইডি থেকে এক জন ফটোগ্রাফার নিয়েছি। আমাদের নিজস্ব প্রেস উইংয়ের এক জন ফটোগ্রাফার ছিলেন। এছাড়া আমরা বিদেশি গণমাধ্যম থেকে নিয়েছি আলজাজিরা ও নেত্র নিউজকে। আয়নাঘরের বিষয়ে নেত্র নিউজের যথেষ্ট অবদান আছে।
আয়নাঘরের আলামত নষ্ট করা প্রসঙ্গে শফিকুল আলম বলেন, আলামত নষ্ট করা হয়েছে কী হয়নি সেটা গুম কমিশন দেখছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটররাও সেগুলো দেখছেন। প্রত্যেকটা ‘আয়নাঘর’ এভিডেন্স হিসেবে সিলগালা করা থাকবে। কারণ, আমাদের লিগ্যাল প্রসেসে এগুলো লাগবে। গুম কমিশন বলবে, আলামত আদৌ নষ্ট হয়েছে, কী হয়নি। কিছু কিছু জায়গায় দেখেছি যে, প্লাস্টার করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় রুম ছোট ছিল দেওয়াল ভেঙে বড় দেখানো হয়েছে। এটা ইচ্ছাকৃত নাকি অনিচ্ছাকৃত, সেটা গুম কমিশন এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিচার করবেন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের যারা গুম-খুন-হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, সবার বিচার হবে।
তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে গত জুলাই মাসে সাদা পোশাকের লোকজন তুলে নিয়েছিল। তুলে নেওয়ার পর তাদের টর্চার সেলে (নির্যাতনকেন্দ্র) রাখা হয়। গতকাল সেই টর্চার সেল পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষগুলো শনাক্ত করেন তারা। প্রধান উপদেষ্টার সহকারী প্রেস সচিব শুচিস্মিতা তিথি গতকাল তার ফেসবুকে দেয়া পৃথক পোস্টে এ তথ্য জানান।
শুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, ‘গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেয়ার পর ডিজিএফআইয়ের এই টর্চার সেলে (নির্যাতনকেন্দ্র) রাখা হয়েছিল নাহিদ ইসলামকে। আজ সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি শনাক্ত করেন নাহিদ। এই কক্ষের এক পাশে টয়লেট (শৌচাগার) হিসেবে একটি বেসিনের মতো ছিল বলে জানান তিনি। ৫ আগস্টের পর এই সেলগুলোর মাঝের দেওয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রং করা হয়।
শুচিস্মিতা তিথি তার ফেসবুকে দেয়া আরেকটি পোস্টে অপর একটি কক্ষের কয়েকটি ছবি দেন। একটি ছবিতে আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া রয়েছেন। শুচিস্মিতা তিথি লিখেছেন, গত জুলাইয়ে সাদা পোশাকে তুলে নেয়ার পর ডিজিএফআইয়ের এই টর্চারসেলে রাখা হয়েছিল আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে। সেখানে পরিদর্শনে গিয়ে কক্ষটি চিনতে পেরেছেন তিনি। দেয়ালের ওপরের অংশের খোপগুলোয় অ্যাডজাস্ট ফ্যান ছিল বলে জানান তিনি।
গত ১৯ জানুয়ারি গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন (দ্য কমিশন অব এনকোয়ারি অন এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্স) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্র্বতী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে। বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টাকে গুমের ঘটনায় তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে জানিয়ে ‘জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেল’ যা ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে তা পরিদর্শনের অনুরোধ জানান কমিশনের সদস্যরা।
মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-ের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৬৯৯ জন। আর এ সময়ে গুম হন অন্তত ৬৭৭ জন। গুমের শিকার বেশির ভাগের সন্ধান পাওয়া যায়, যাদের গ্রেফতার দেখায় পুলিশ। আলোচিত গুমের ঘটনার মধ্যে বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালক, দলটির সাবেক এমপি সাইফুল ইসলাম হীরুসহ অন্তত ২৫ নেতার সন্ধান এখনো মেলেনি।