বাংলার স্বাধীনতা ও মীরজাফরদের করুণ পরিণতি

……………………. এম. আমিরুল ইসলাম (জয়)……………….

আজ ২৩ শে জুন। ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের এই দিনে বর্তমান ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার “পলাশীর মাঠ” নামক মাঠে স্বাধীন বাংলার লাল সুর্যটি প্রায় ২০০ বছরের জন্য ছিনতাই হয়ে গিয়েছিল চতুর ও চিকন বুদ্ধির ইংরেজ অধিপতি লর্ড ক্লাইভের কাছে। এই দিনে ইতিহাসের পাতা কাঁপানো জাতীয় বেঈমান মীরজাফর ও ঘসেটি বেগমের ভয়ংকর প্রাসাদ ষড়যন্ত্র নবাব সিরাজ উদ-দৌলার করুণ পরাজয় ও পরিনতির পথকে প্রশস্ত করে। তবে এই পরাজয় ও পরিণতি ব্যক্তি নবাবের ব্যক্তিগত আর থাকেনি ; হয়েছিল তামাম বাংলার মানুষের স্মরণকালের সেরা করুণ পরাজয় ও পরিনতি। এই জন্যই পলাশীর যুদ্ধকে প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে শুরু করে বর্তমান ইতিহাসের পাতায় সর্বকালের সেরা ইতিহাস পরিবর্তনকারী যুদ্ধ বলা হয়। প্রকৃত পক্ষে, ২৩ শে জুন তারিখের যুদ্ধ কোন যুদ্ধই ছিল না; ছিল ইতিহাসের সেরা প্রহসন। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার ছিল ৫৩ হাজার সৈন্য ; আর ইংরেজদের মাত্র ৩ হাজার ! নবাবের এত সৈন্য; অথচ তাদের থেকে কোন গুলিই প্রায় বের হলো না! নবাবের ১০০টি রণহস্তির ১০ টিই লড ক্লাইভকে কাবু করার জন্য যথেষ্ট ছিল । কারণ এই হস্তি যাকে তাড়া করে তাকে পিষে না মারা পর্যন্ত থামে না। কোথায় ৫৩ হাজার আর কোথায় ৩ হাজার! সংখ্যাটা সেদিন কোনো কাজেই আসেনি। কারণ  সিরাজ বধের প্রথম চিত্রনাট্য আগেই পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল। সেটা একই সালের ৯ ই জুন। ঐদিন মীরজাফরের পুত্র মীরনের কাঠগোলা বাগান বাড়িতে বসে এক গোপন বৈঠক। ঐ ষড়যন্ত্রমূলক গোপন বৈঠকেই নির্ধারিত হয় সিরাজের পতনের পর কে কি পাবে । মসনদ পাবে মীরজাফর। রাজ উপাধী ও সিপাহ সালার পদ পাবে রাজ বল্লভ। জগৎশেঠ পাবে প্রচুর অর্থ। উর্মিচাঁদ পাবে ২০ লাখ টাকা আর ইংরেজ বেনিয়াদের নেতা ক্লাইভ পাবে একটি গ্রামের জমিদারীসহ কোটি টাকা। যা হোক, যুদ্ধ তো হল না ; হল প্রহসন। ছোট ছোট কিছু সেনা ইউনিটের প্রধান ছিলেন মোহনলাল ও মীরমদন। বড় বড় ব্রিগেডের উপর তাদের কোন কর্তৃত্বই ছিল না। ঔগুলির কমান্ডার ছিলেন মীরজাফর। তবুও প্রাণপণে যুদ্ধ করে ইংরেজদের নাস্তানাবদ করে ছাড়লেন নবাব বিশ্বস্ত মোহনলাল ও মীরমদন। নবাবের জয় প্রায় নিশ্চিত। অন্য দিকে সকাল থেকেই মীরজাফরদের নিষ্ক্রিয়তার খবর নবাব সিরাজ পাচ্ছিলেন। তিনি তাদের ডেকে পাঠালেন এবং ভাঙ্গাচুরা কাতর গলায় মিনতি করে বললেন  “ বাংলার স্বাধীনতা আজ বড় বিপন্ন ! অস্তমিত হতে যাচ্ছে বাংলার স্বাধীনতার লাল সূর্য !! একমাত্র তোমরাই পার বাংলাকে বাঁচাতে !!! ”

মীরজাফরসহ অন্যান্যরা পবিত্র কোরআন শপথ করলেন এবং বললেন, “ কাল থেকে আবার নতুন করে যুদ্ধ শুরু হবে। আজ সৈন্যরা ক্লান্ত, তাদের বিশ্রাম দরকার। আজকের মত যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেন, জাহাপনা”। অন্যদিকে মোহনলাল ও মীরমদন বললেন, “না, যুদ্ধ বন্ধ করলেই সর্বনাশ ”। নবাবের নিকটে এ এক কঠিন ক্লান্তিকাল !। ৫০ হাজার সৈন্যের কমান্ডার মীরজাফরের কথা না শুনলে তারা বিদ্রোহ করবে। তাদের পাল্টা আক্রমনে তৃণের মত ভেসে যাবে মোহনলাল ও মীরমদন বাহিনী। তার উপরে ঘরে বাইরে সবখানে শত্রু। কে ভালো কে মন্দ, কে আপন কে পর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। অবিশ্বাসের এই চরম মহাক্রান্তিকালে একমাত্র বিশ্বাসী হয়ে উঠল আল্লাহু তায়ালার প্রিয় গ্রন্থ মহা পবিত্র কোরআন শরিফ। নবাব শপথ করালেন এবং যুদ্ধ বন্ধ করার আদেশ দিলেন। ব্যাস ! তৎক্ষনাৎ মীরজাফর লিখে পাঠালেন ক্লাইভকে, “ দিশাহীন অসহায় নবাব ! এই মূহুর্তে ঘিরে ফেল সিরাজ বাহিনীকে এবং উপড়ে ফেলো সিরাজ বাহিনীর বিষ দাঁত”। পরদিন ২৩ শে জুন নবাবের বেশির ভাই সৈন্যরাই শহিদ হয়ে গেলেন ; বাকীরা পালালেন। পালাতে গিয়ে নবাবও পাটনার পথে ধরা পড়লেন এবং ২রা জুলাই কারাগারের ভিতরেই মোহাম্মদী বেগ তাখে নির্মম ভাবে শিরচ্ছেদ করলেন। পরদিন প্রকাশ্যে রাজ পথে মস্তক বিহীন নবাবের নিথর দেহ তামাম মুর্শিদাবাদ শহর ঘোরানো হচ্ছে তারই প্রিয় হাতির পিঠে। আর ঘসেটি বেগম মিষ্টি মুখ করাচ্ছেন ! সেদিন মীরজাফরদের অট্টহাসিতে আকাশ বাতাশ হয়েছিল প্রকম্পিত ! রাস্তার পাশে শুধু মানুষ আর মানুষ। দেখছে বাংলার বেঈমানদের বিশ্বাস ঘাতকতার পাশাপাশি তাদের ঘৃণ্য পাশবিকতার  ঘৃন্য প্রদর্শন। তবে নিয়তির নির্মম পরিহাস এই জাতীয় বেঈমানদের কারোরই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। পুরো পৃথিবী দেখেছে তাদের উপর প্রকৃতির প্রতিশোধ ; অভিশাপ নেমে এসেছিল। মীরজাফর ক্ষমতায় বসলেও বাংলার লোকেরা তাকে “ ক্লাইভের গাঁধা” বলত। তার পতন হয় নির্মম ভাবে। দূর্নীতির দায়ে তাকে বহিস্কার করা হয়। পরে কুষ্ঠ রোগে অসংখ্যা ফোড়া-পুজ রক্তে তার শরীরে পচন ধরে। বাড়ীর লোকজন তাকে এক জঙ্গলের মধ্যে রেখে আসে। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মীরজাফরের পুত্র মীরনের নির্দেশেই নবাব হত্যা কান্ড সংঘটিত হয়। সেই মীরনের মৃত্যু বজ্রাঘাতে হয়।

নবাব সিরাজ উদ-দৌলার হত্যার পিছনে নবাবের আপন খালা ঘসেটি বেগমের ভূমিকা ছিল সাংঘাতিক। তার জীবন সুখের হয়নি। যারা ছিল ঘসেটির দোসর তারাই হল কাল। মীর জাফর পুত্র মীরন তাকে ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দি করে রাখে। পরে পরিকল্পিত ভাবে তাকে মুর্শিবাদে নিয়ে যাবার ছলে ঢাকার বুড়ি গঙ্গা নদীতে নৌকা ডুবি ঘটিয়ে হত্যা করে। মোহাম্মদী বেগ ছিল সিরাজেরই মা আমিনা বেগমের পালিত পুত্র। পথ থেকে কুড়িয়ে পুত্রের পরম মমতায় মানুষ করেন আমিনা। অথচ মাত্র ১০ হাজার টাকার লোভে সিরাজকে নির্মম ভাবে হত্যা করে। দু’রাকাত নামাজ পড়ারও সুযোগ দেয়নি। নিয়তি সেই মোহাম্মদী বেগকেও তাড়া করে পাগল বানিয়ে রাস্তায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অবশেষে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। রায় দুর্লভ ও জগৎশেঠকে মীর কাসিম দূর্গের চুড়া থেকে বস্তায় ভরে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে হত্যা করে। রাজা রাজবল্লভকে বালুর বস্তা গলায় বেধে হত্যা করে গঙ্গায় ফেলে দেওয়া হয়। বেচারা উর্মিচাঁদ টাকা না পেয়ে প্রথমে পাগল এবং পরে কুষ্ঠ রোগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। মীর কাসিম ছিল মীরজাফরের জামাতা ও মীরনের ভগ্নিপতি। ভগবান গোলায় ছদ্মবেশে তিনি নবাবকে ধরিয়ে দেন। সেই মীর কাসিমের জীবনেও নেমে এসেছিল অমানিশার কঠিন অন্ধকার। ইংরেজ বিদ্ধেষের কারণে ইংরেজরা তার দুই পুত্রকে হত্যা করে। কয়েকটি যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে ফকিরের ছদ্মবেশে দিল্লীর পথে পথে ঘুরে বেড়াতেন। একদিন স্থানীয়রা দেখলো ছেঁড়া আর নোংরা কাপড় পরিহিত ফকিরটি মারা গেছে। আর তারা তাকে  বেওয়ারিশ লাশ হিসাবে কাফন ছাড়াই দাফন করে দিল!  অবশেষে আসে লর্ড ক্লাইভের পালা। বাংলা লুণ্ঠন, হত্যা ও দূর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ফাঁিসর রায় হয়। তবে বিশেষ বিবেচনায় ফাঁসি থেকে নিষ্কৃতি পেলেও দীর্ঘদিন জেল খাটার পরে টেমস নদীতে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান। সবশেষে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়,  এতকিছু দেখেও মীরজাফরেরা কিন্তু ইতিহাস থেকে ভালো কোনো কিছুই শেখে না ; তারা করোনার থেকেও ভয়ংকর ও বিপদ জনক। আসলে বিশ^াস ঘাতকেরা চিরদিনই বিশ^াসঘাতকতা করে। ছিঁড়ে ফেলে শপথের মালা। এ কারণেই বাংলার মীরজাফরেরা শেষ হয়ে গেলেও পৃথিবীর মীরজাফরেরা এখনো আছে-ছিল এবং থাকবে ; তবুও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে পৃথিবীর পথে।

লেখক: ইংরেজী প্রভাষক,

আলমডাঙ্গা সরকারি কলেজ।

 

Comments (0)
Add Comment