নজরুল ইসলাম: জীবনে শীতের রস আর নলেন গুড়ের স্বাদ নেননি এমন কোনো মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। শীত এলেই বাংলার পল্লীঅঞ্চলের কোথাও না কোথাও রস আর নলেন গুড়ের সুঘ্রাণ নাকে ভেসে আসে। তবে কিছু অসাধু গাছির কারণে নির্ভেজাল খেজুরের রস গুড়ের শিল্প আজ প্রশ্নবিদ্ধ। অপর দিকে খেজুরের রস বাঁদুড়ে খাওয়ায় নিপাভাইরাসে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্বাস্বাস্থ্য সংস্থা। এতোকিছুর মধ্যেও চুয়াডাঙ্গা সদর কৃষ্ণপুর গ্রামের ডাক্তারপাড়ার কৃষিবিদ শরিফ উদ্দিন বহুজাতিক কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরির কাজ শুরু করেছেন। সেই সাথে খেজুরের রস ও গুড় নিয়ে শুরু করেছেন গবেষণা। গবেষণা সফল হলে একদিন খেজুরের পাটালি ও গুড় বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবে এমনই স্বপ্ন দেখছেন তিনি। তাই চাকরি ছেড়ে কৃষিবিদ শরিফ উদ্দিন এখন গাছি হয়েছেন।
চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার নবগঠিত নেহালপুর ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের ডাক্তারপাড়ার সামসুল ইসলামের ছেলে কৃষিবিদ শরিফ উদ্দিন ২০০৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ময়মনসিংহ থেকে কৃষি অনুষোধে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে বহুজাতিক কোম্পানিতে চাকরি নেন। অন্যের অধীনে চাকরি আর কতোদিন। পরাধীনতার গ-ি থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তিনি। যে কথা সেই কাজ চাকরি জীবনের ১৭ বছর পার করে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে ফিরে আসেন নিজ গ্রামে। কাজের মানুষ কাজ করতে ভালোবাসেন। বসে থাকার পাত্র নন তিনি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লব্ধজ্ঞান কাজে লাগাতে নিজ গ্রামে ২টি খেজুর গাছ সংগ্রহ করেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তৈরি করবেন গুড় ও পাটালি। বিক্রি করার পাশাপাশি রস ও গুড় নিয়ে করবেন গবেষণা। একজন গাছি এবং তিনজন সহযোগীর সমন্বয়ে খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ এবং সেই রস দিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরির শিল্পর কাজ শুরু করেন। খেজুরের সর বাঁদুড়ে খেলে নিপাভাইরাস হবার আশঙ্কা থাকায় প্রতিটি গাছে লাগিয়েছেন মশারির মতো নেট। যাতে করে মশা, মাছি, পাখি কিংবা বাদুড়ে রস খেতে না পারে। সূর্য ওঠার আগেই সেই রস গাছ থেকে সংগ্রহ করে যথাসম্ভব স্বাস্থ্য সসম্মতভাবে তৈরি করে থাকেন গুড় ও পাটালি। গুড় তৈরির সময় কারিগরদের হাতে পরা থাকে হ্যান্ড গ্লাবস। শরীরে পরা থাকে নির্দিষ্ট পোশাক। আমাদের দেশে আশ্বিনের শেষের দিকে গাছিরা খেজুরগাছকে প্রস্তুত করতে থাকেন রস আহরণের জন্যে। গাছের বাকল কেটে চেছে গাছ তোলা হয়। যেখান থেকে নেমে আসবে অমিয়ধারা-তা সাফ-সুতরো করতে থাকে গাছিরা। এক একজন সুদক্ষ সুশিক্ষিত গাছি কোমরে মোটাদড়ি বেঁধে ধারাল গাছিদা দিয়ে পরম নৈপূণ্যে তা কাটে! গাছতোলা শেষে গাছ কাটার পালা, অর্থাৎ রস বেরুনোর পথ তৈরি করা। নিপুণ হাতে গাছের উপরিভাগের নরম অংশকে অপরূপ সৌন্দর্যে কেটে গাছি সেখানে বসিয়ে দেন বাঁশের তৈরি নালা। গাছের কাটা অংশ থেকে চুইয়ে চুইয়ে রস এসে নল দিয়ে ফোটায় ফোটায় জমা হয় ঠিলেয় (হাঁড়ি)। প্রথম রস একটু নোনা। গাছি এক কাটের পর বিরতি দেন! কিছুদিন বিরতির পর আবার কাটেন। এবারের রস সুমিষ্ট যার মৌ মৌ সুগন্ধ ছড়ায় চারদিকে। চাকরি ছেড়ে এ কাজ বেঁচে নেয়ার ব্যাপারে শরিফ উদ্দিন বলেন, কৃষি বিষয়ে লেখাপড়া করেছি। সেই শিক্ষাকে কাজে লাগাতেই আজকের এই পরিকল্পনা। দেশে খেজুরের গুড় পাটালি নিয়ে ভোক্তাদের মধ্যে নানা সন্দেহ। প্রায় শুনতে পায় গুড়ের দাম বেশি হওয়ায় কিছু অসাধু ব্যবসায়ী চিনি দিয়ে গুড় তৈরি করে থাকে। খেজুরের গুড়ের প্রকৃত স্বাদ ও ঘ্রাণ নেই বললেই চলে। তাই আমি সেই ঘ্রাণ ও স্বাদ বজাই রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। সেই সাথে বারো মাস যাতে খেজুরের রস থেকে কিভাবে গুড় ও পাটালি তৈরী করা যায় সে নিয়ে গবেষণা করছি। আমার গবেষণা সফল হলে একদিন দেশের গুড়-পাটালি বিদেশে রফতানি হবে। দেশে অর্জিত হবে বৈদেশিক মুদ্রা। এদিকে অতি মুনাফালোভি ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে জেলার খেজুরের গুড় ও পাটালির সুনাম হারাতে বসেছে। শীত মরসুমে অলি-গলি ও দোকানে যে পাটালি-গুড় পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই ভেজাল। কম দামের চিনি মিশিয়ে খেজুরের পাটালি বলে তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। কয়েকজন গাছির সাথে কথা বলে জানা গেছে, খেজুরের রস যখন জ্বালানো হয়, সেই সময় তাতে চিনি মিশিয়ে ‘বীজ’ মেরে পাটালি তৈরি করা হয়। পাটালির গন্ধ করতে তাতে বিশেষ কেমিকেল ব্যবহার করেন তারা। এরপর সেই পাটালি বা গুড়কে খাঁটি বলে ক্রেতাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়। বিশেষজ্ঞ একজন ডাক্তার বলেন, খেজুর রসে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় মূলত বাদুড়ের লালা, বিষ্ঠা ও প্রস্রাবের মাধ্যমে। বাদুড় যখন খেজুর গাছের নলিতে বসে রস পান করে, সেই সময় তার লালা, বিষ্ঠা ও প্রস্রাব রসের ভাড়ে যায়। তবে, রস যদি একটু জ্বালিয়ে পান করা যায়, তবে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। তিনি আরও বলেন এর এন্টিভাইরাল কোনও ওষুধ নেই। আক্রান্ত রোগীদের সাধারণ চিকিৎসা দেয়া হয়। যেহেতু স্পেসিফিক ওষুধ নেই, সেক্ষেত্রে এই রোগে আক্রান্তদের অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা যায়। তাই সতর্কতাই বেশি জরুরি।