স্টাফ রিপোর্টার: হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন বন্ধে অ্যাকশন শুরু করেছে সরকার। হুন্ডি কারবারিদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠান বিকাশ, রকেট, নগদসহ অন্যান্য অপারেটরের লেনদেনে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, দুবাই, ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হুন্ডিতে অর্থ পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। যার ফলে দেশের ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার সংকট তৈরি হয়েছে।
এদিকে হুন্ডি বন্ধ ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো সহজ করা প্রয়োজন বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বিদেশে রেমিট্যান্স একচেঞ্জ হাউসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো, প্রবাসীদের ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে সচেতনতা তৈরি করতে ব্যাংকগুলোকে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালনের পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ানোর জন্য বিদেশে রেমিট্যান্স হাউসগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে। দেশে রেমিট্যান্স গ্রহণকারীর আত্মীয়স্বজনকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধা জানাতে হবে। ব্যাংকগুলোর উদ্যোগে বিদেশে প্রবাসী এবং দেশে স্বজনদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। রেমিটারদের জন্য গৃহঋণসহ আরও কী কী সুবিধা দেয়া যেতে পারে- এসব বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নতুন নতুন প্রডাক্ট চালু করতে হবে।
বেসরকারি ব্যাংক এমডিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান আরও বলেন, রেমিটাররা সারাজীবন বিদেশে থাকেন না। এক সময় দেশে ফিরে আসেন। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে দেশে ফিরে সেই টাকা প্রদর্শন করে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করতে পারবেন। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠালে সেই টাকা প্রদর্শন করার সুযোগ পাবেন না। বিনিয়োগ করতে গেলে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। এসব বিষয়ে প্রবাসীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কর্মসূচি নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানায়, বিদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে প্রবাসী আয় আনায় বিকাশ, রকেট ও নগদের ২৩০ জন গ্রাহকের হিসাব জব্দ করেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পাশাপাশি কয়েকজন এমএফএস এজেন্টের হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। এর আগে একই অপরাধে জড়িত থাকায় ৫ হাজার ৪১৮ এমএফএস এজেন্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগকে (সিআইডি) চিঠি দিয়েছিলো বাংলাদেশ ব্যাংক। যার মধ্যে কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ।
কয়েকজন প্রবাসী জানিয়েছেন, খাবার হোটেল, সুপারশপ, মুদি দোকানে সাইন বোর্ড টাঙিয়ে বিকাশ, রকেটের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করছে হুন্ডি কারবারিরা। প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার জমা নিয়ে দেশে বসে তাদের আত্মীয়স্বজনের বিকাশ, রকেট ও নগদ নম্বরে টাকা জমা করে দিচ্ছে। আবার অনেক সময় প্রবাসী শ্রমিকদের বাসায় গিয়ে ডলার সংগ্রহ করে হুন্ডি ব্যবসায়ীরা। ডলারের সমপরিমাণ অর্থ প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের কাছে ও বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। ফলে কোনো ডলার দেশে আসছে না।
এদিকে অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রবাসীদের আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, অবৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে প্রমাণসাপেক্ষে প্রচলিত আইনে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সতর্কবার্তায় বলেছে, প্রবাসী বাংলাদেশি ও তাদের প্রিয়জনদের জানানো যাচ্ছে, কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে (হুন্ডি বা অন্য কোনো অবৈধ পথে) প্রেরণ করা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ, এতে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আপনাদের অর্জিত মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রা হুন্ডি বা অন্য কোনো অবৈধ পথে না পাঠিয়ে বৈধ পথে/ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে প্রেরণ করুন। দেশ গড়ায় মূল্যবান অবদান রাখুন এবং আপনার প্রিয়জনকে ঝুঁঁকিমুক্ত ও নিরাপদ রাখার অনুরোধ জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এদিকে অর্থ পাচার রোধকারী সংস্থা বিএফআইইউর তথ্যের ভিত্তিতে গত সেপ্টেম্বরে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি জানায়, এমএফএস প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্তত ৫ হাজার এজেন্ট অবৈধভাবে বিদেশ থেকে অর্থ আনা ও বিদেশে অর্থ পাঠানোর কাজের সঙ্গে জড়িত। হুন্ডির এই চক্রের কারণে বাংলাদেশ সরকার বছরে প্রায় ৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার (৭৫ হাজার কোটি টাকা) প্রবাসী আয় বঞ্চিত হচ্ছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান এবং হুন্ডিতে জড়িত ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জাইদি সাত্তার বলেন, ব্যাংকিং চ্যানেল এবং হুন্ডিতে ডলারের একচেঞ্জের রেটের অনেক পার্থক্য রয়েছে। ব্যাংকের চেয়ে হুন্ডি রেট বেশি হওয়ার ফলে রেমিটাররা ভালো দাম পাওয়ায় হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছেন। ডলারের একচেঞ্জ রেটের পার্থক্য যতদিন দূর না হবে ততদিন হুন্ডি বন্ধ করা কঠিন। হুন্ডি ঠেকানোর জন্য ডলারের বিনিময় রেট উন্মুক্ত করতে হবে। ব্যাংক এবং হুন্ডির রেটের খুব বেশি পার্থক্য না থাকলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়বে। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ৯ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে মধ্যপ্রাচ্য ও দুবাইতে সবচেয়ে বেশি গেছেন। তার মানে প্রবাসের কর্মকান্ড পুরোদমে শুরু হয়েছে। তারপরও বৈধপথে রেমিট্যান্স বাড়ছে না।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ বলেন, এখন যেসব দেশ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ হচ্ছে, সেই পরিধিটা আরও বাড়াতে হবে। প্রচলিত দেশগুলোর বাইরেও দক্ষিণ আফ্রিকা, মোজাম্বিকসহ অনেক জায়গায় বাঙালিরা আছেন। এগুলো চিহ্নিত করে ব্যাংকগুলোতে যেতে হবে। ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো আরও সহজ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, রেমিট্যান্স কিন্তু সব সময় এক পরিমাণ আসবে না। রেমিট্যান্স আসার মৌসুম আছে। দুই ঈদ এবং পয়লা বৈশাখের সময় সবচেয়ে বেশি আসে। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বিদেশে নির্মাণ শিল্পের কাজ হয়। তখন প্রবাসীরা আত্মীয়স্বজনের জন্য টাকা পাঠান। এই সময়ে ঋণ করে হলেও দেশে টাকা পাঠান। ফলে রেমিট্যান্স বাড়ে। ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বলেন, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, অর্থ, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়কে একযোগে কাজ করতে হবে। তাহলে বিদেশি বিনিয়োগ ফেরত যাবে না। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে রিজার্ভের পরিমাণ বাড়বে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো ঠিকমতো কাজ করলে রিজার্ভ নিয়ে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তিনি আরও বলেন, এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব নেয়া উচিত প্রবাসীরা কীভাবে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বৈধ পথে টাকা পাঠাতে পারে সেই ব্যবস্থা চালু করা। মোবাইল ব্যাংকিং সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি রেমিট্যান্স গ্রহণের সিস্টেম চালু করার অনুমতি দিতে হবে। এখন হুন্ডি নিয়ন্ত্রণ করছে স্টক মার্কেটের দালালরা। বিভিন্ন দেশে তাদের দালালরা প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার কিনে বেশি দামে বিক্রি করছে। ব্যাংকে পাঠানো সমস্যা। ব্যাংকের লোক স্যুট-প্যান্ট পরে অফিস করেন। রেমিট্যান্স সংগ্রহে খরচ বেশি। তাই মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানিগুলোকে রেমিট্যান্স পাঠানোর দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম ১০ মাসে ৯ লাখ ৪৭ হাজার ৮৭ জন শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে গেছেন। যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল মাত্র ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৩২ জন। চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত প্রতি মাসে গড়ে ৯০ হাজার শ্রমিক কাজের জন্য বিদেশে গেছেন। প্রবাসে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বাড়লেও আগের মাসের তুলনায় রেমিট্যান্স কমেছে অক্টোবর মাসে। অক্টোবরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৫২ কোটি ডলার। যা আগের মাসের তুলনায় ৭ দশমিক ৪ শতাংশ বা ১২ কোটি ডলার কম। সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ১৬৪ কোটি ডলার। বর্তমানে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য ডলার রেট ১০৭ টাকা, সঙ্গে ২ দশমিক ৫ শতাংশ সরকারি প্রণোদনা। অন্যদিকে হুন্ডিতে ডলার রেট প্রায় ১১৪-১১৫ টাকা। যে কারণে প্রবাসীরা হুন্ডিতেই বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন।