পপি বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ছিলেন শিশু সন্তানকে
স্টাফ রিপোর্টার: নেত্রকোনা সদর থেকে ঢাকায় ফিরছিলেন একই পরিবারের নয়জন। গত সোমবার রাতে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে ওঠেন তারা। নয়জনের মধ্যে পাঁচজন বিমানবন্দর রেলস্টেশনে নেমে যান। বাকি চারজনের নামার কথা ছিল কমলাপুর রেলস্টেশনে। কিন্তু বনানী রেলস্টেশন পার হওয়ার পর হঠাৎ ধোঁয়ায় ভরে যায় ট্রেনের কামরা। আগুন-আগুন বলে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। তেজগাঁও স্টেশনে ট্রেন থামতেই সবাই হুড়োহুড়ি করে নামতে থাকেন। শুধু চার হতভাগ্য নামতে পারেননি। তাদের মধ্যে ছিলেন নাদিরা আক্তার পপি (৩৫) ও তার তিন বছরের ছেলে ইয়াসিন। আগুনে পুড়ে জীবন্ত দগ্ধ হয় মা-ছেলে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিশু সন্তান ইয়াসিনকে বুকে আগলে বাঁচানোর চেষ্টা করেন পপি। তাদের লাশ যখন উদ্ধার করা হয়, তখনও পপি বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ছিলেন শিশু সন্তানকে। তবে একই ট্রেনে থাকা পপির ভাই হাবিব (১৮) ও পপির বড় ছেলে ফাহিম (৯) আগুন লাগার সময় ট্রেন থেকে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচান। তারা বেরোনোর সময় আঘাত পেয়ে আহত হয়েছেন। এ খবর শুনে নেত্রকোনার গ্রামের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
পপির দেবর প্রকৌশলী মিনহাজুর রহমান বলেন, ভাবির কোলে ছিল ছোট্ট ইয়াসিন। বাচ্চা নিয়ে উনি আর নামতে পারেননি। আগুন নেভানোর পর ওনার লাশ উদ্ধার করা হয়। তখনও তার কোলে ছিল সন্তান ইয়াসিনের লাশ। দুজন একসঙ্গে পুড়ে মারা গেছেন। তার ভাই মিজানুর রহমান কারওয়ান বাজারে হার্ডওয়্যার সামগ্রীর ব্যবসা করেন। দোকানের নাম রহমান এন্টারপ্রাইজ। তিনি রাজধানীর তেজতুরী বাজার এলাকায় থাকেন। তার সঙ্গেই থাকতেন পপি ও তাদের দুই সন্তান।
গত সোমবার গ্রামের বাড়ি থেকে অন্য স্বজনের সঙ্গে তারা ঢাকায় ফিরছিলেন। তারা সবাই ছিলেন ‘জ’ কোচের যাত্রী। তাদের মধ্যে পপির বড় ছেলে ফাহিম ও পপির ভাই হাবিব ট্রেন থেকে নামতে পেরেছেন। পরে তারা লক্ষ্য করেন যে পপি ও ইয়াসিন নেই। কিন্তু ততক্ষণে ট্রেনের ওই কোচটিতে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ফলে কিছুই করার ছিল না। ফায়ার সার্ভিস আগুন নেভানোর পর ট্রেনের বগি থেকে চারজনের লাশ উদ্ধার করে। তাদের মধ্যে পপি ও তার সন্তানের লাশও ছিল।
পপির স্বামী মিজানুর রহমান বলেন, আমি কমলাপুরে স্ত্রী-সন্তানদের রিসিভ করার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু ট্রেনে আগুনের খবর শুনে আমি নির্বাক হয়ে যাই। পরে জানতে পারি আগুনে পুড়ে আমার স্ত্রী ও সন্তান মারা গেছে। আমার এ কষ্ট কাউকে বলতে পারব না।
পপির দেবর দেলোয়ার হোসেন টিটু জানান, সবাই যদি বিমানবন্দর স্টেশনে নেমে যেত তাহলে ভাবি ও বাচ্চাটা বেঁচে যেত। পপির বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার বরুনা গ্রামে। তেজতুরী বাজারে স্বামী মিজানুর রহমানের সঙ্গে থাকতেন তিনি। ভাবির বড় ছেলে ফাহিম তেজগাঁওয়ের একটি স্কুল থেকে চতুর্থ শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে। গতকাল বিকালে মা-ছেলের লাশ বিনা ময়নাতদন্তে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাদের গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে। পপির ভাই হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, ঢাকার তেজগাঁও তেজতুরী বাজার এলাকায় তারা থাকেন। গত ৩ ডিসেম্বর বেড়ানোর উদ্দেশে নেত্রকোনার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন। সেখান থেকেই সোমবার রাত ১২টার দিকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে নেত্রকোনা বড় স্টেশন থেকে ঢাকায় রওনা দিয়েছিলেন। ভোরে তাদের ঢাকায় পৌঁছুনোর কথা ছিল। বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ট্রেনটা চলতে শুরু করার পর পেছনের সিট থেকে আগুন জ্বলে ওঠে। মুহূর্তেই আগুন পুরো বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে দৌড়ে তিনি ফাহিমকে নিয়ে ট্রেন থেকে নামতে পারলেও ভিতরে আটকা পড়েন ছোট ইয়াসিন ও তার মা পপি। তাদের কোনোভাবেই বের করতে পারেননি। পরে ফায়ার সার্ভিস এসে তাদেও লাশ বের করে। নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার বৈরাটি ইউনিয়নের আলমপুর গ্রামের বাসিন্দা পপির বাবা ফজলুর রহমান বলেন, আমার মেয়ে-নাতিকে কেন মারা হলো, কী অপরাধ আমার সন্তানের, কার জন্য আমার এই ক্ষতি করা হলো, এর বিচার কে করবে, কার কাছে আমি বিচার চাইব, তিন বছরের নিষ্পাপ শিশুটিকে আগুনে পুড়িয়ে কেন হত্যা করা হলো? আমি আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।
পপির শাশুড়ি মেহেরুন নেসা ও চাচাশ্বশুর আবদুল কাদির মিলন বলেন, আমরা এ নির্মম হত্যাকা-ের বিচার চাই। যারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।
এদিকে, মা-ছেলের মর্মান্তিক এ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না নেটিজেনরা। তারা সোশ্যাল মিডিয়ায় পপি ও তার ছেলের ছবি শেয়ার করে শোক প্রকাশ করছেন। অনেকেই এ হত্যাকা-ের বিচার দাবি করছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী নুরুল হক যা বললেন: গতকাল ভোরে তেজগাঁও রেলস্টেশনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসে দুর্বৃত্তরা আগুন দেয়ার পর ট্রেন থেকে তাড়াহুড়া করে নামতে গিয়ে নুরুল হক ওরফে আবদুল কাদের মাথায় আঘাত পান। তাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি হামীম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের পরিবহন শাখায় প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত। তার গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া থানার ধুনিয়াগাঁও। বর্তমানে তিনি তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া এলাকায় থাকতেন। ট্রেনে অগ্নিকা-ের ঘটনায় প্রত্যক্ষদর্শী আহত নুরুল হক বলেন, আমি ‘জ’ বগির ২৯ নম্বর সিটে ছিলাম। সোমবার রাত ১২টায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ছেড়ে আসে। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে বিমানবন্দর রেলস্টেশনে এসে পৌঁছলে, অধিকাংশ যাত্রী নেমে যান। পরে ট্রেনটি কমলাপুর রেল স্টেশনের উদ্দেশে ছেড়ে আসার সময় অনেকটাই ফাঁকা ছিল। বনানী স্টেশন পার হওয়ার পর বগিতে ধোঁয়া দেখে সঙ্গে থাকা ব্যাগ নিয়ে চলন্ত ট্রেন থেকে নাখালপাড়া এলাকায় লাফিয়ে পড়ি। এতে মাথায়, বা পায়ের হাঁটুতে ও কোমরে আঘাত লাগে। কিন্তু বেঁচে ফিরেছি এটাই বড় বিষয়। আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মা-শিশু আমার পাশের সিটের যাত্রী ছিলেন। নাখালপাড়ায় রেললাইনে আধা ঘণ্টার বেশি সময় পড়ে ছিলাম। পরে নিজের মোবাইল থেকে অফিসে ফোন দিয়ে জানালে হা’মীম গ্রুপের গাড়ির চালক ইসমাঈল হোসেন এসে উদ্ধার করে আমাকে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করে।