সুষ্ঠু নির্বাচন চান বিশিষ্টজনরা অংশগ্রহণমূলক চান সিইসি

স্টাফ রিপোর্টার: অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে সাহসী হতে নির্বাচন কমিশনকে তাগাদা দিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। তারা নির্বাচন ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফেরানো, ইভিএম ব্যবহার না করা, দলীয় সরকারের সময় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন করাসহ নানা পরামর্শ দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত স্থাপনের আহŸান জানিয়েছেন কমিশনকে। অন্যদিকে আস্থা ফেরাতে ও মানুষকে নির্বাচনমুখী করতে বিশিষ্টজনদের সহযোগিতা চেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, গণতন্ত্র সুসংহত করতে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অপরিহার্য। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে বিশিষ্ট নাগরিকদের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপ চলাকালে পরস্পরের প্রতি এমন আশাবাদ রাখেন তারা। গত ফেব্রæয়ারিতে নতুন ইসি গঠনের পর আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ তৈরির জন্য ধারাবাহিক এই সংলাপ চলছে। এর দ্বিতীয় সংলাপে মতামত দেয়ার জন্য বিভিন্ন পেশার ৩৯ বিশিষ্টজনকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও এতে অংশ নিয়েছেন মাত্র ১৯ জন। এর আগে গত ১৩ মার্চ ৩০ শিক্ষাবিদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করলে সেদিন উপস্থিত ছিলেন মাত্র ১৩ জন।

মঙ্গলবারের সংলাপে বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ বলেন, অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সংবিধান ও আইনে ইসিকে যে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তা তারা কতখানি প্রয়োগ করতে পারবে, সেটি অনেকাংশে নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকারের ওপর। নির্বাচনকালীন সরকার এমন হতে হবে, যাদের ভোটের ফলাফল নিয়ে কোনো আগ্রহ থাকবে না।

বিশিষ্টজনদের কেউ কেউ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। কমিশন যদি মনে করে, নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে আইন ও সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন, তাহলে তারা সরকারকে প্রস্তাব দেবে। আর যদি মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে পদত্যাগের মানসিকতা রাখতে হবে। আলোচকরা বলেছেন, ভোট ব্যবস্থাপনার প্রতি ভোটারদের আস্থা ফেরাতে হবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতে উদ্যোগী হতে হবে। সেইসঙ্গে কমিশনকে কাজ দিয়েই প্রমাণ করতে হবে, তারা নিরপেক্ষভাবে ভোট করবেন। সংলাপে বিশিষ্টজনদের অনেকেই ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা ব্যবহার না করার পরামর্শ দিয়েছেন।

এ বিষয়ে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ইভিএম ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করে দিতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে ইভিএম ব্যবহার করা উচিত নয়।’

সিপিডির মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ইভিএম ব্যবহার করলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। একটি ভালো ও নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবেন।’ লেখক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ যন্ত্রে যে ম্যানুপুলেট করা যায় না, তা নিশ্চিত না করে ব্যবহার করা যাবে না।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ফরাস উদ্দিন বলেন, ‘ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এটার সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলব, ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য।’

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ইভিএম’র বিরোধিতা করে বলেন, ‘বিনা টেন্ডারে কীভাবে ইভিএম এলো। ইভিএম নিয়ে একজনের এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনোভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫-১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারে। তবে এটা না হওয়াই ভালো।’

সংলাপে বিশিষ্টজনদের সবাই নির্বাচন কমিশনকে নিরপেক্ষ থেকে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন করার পরামর্শ দিয়েছেন। আস্থা ফেরাতে কাজ দিয়ে নিজেদের প্রমাণ করার পরামর্শ দেন তারা।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন আইন-বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেন কি না তা দেখা যাবে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সাহসিতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।’

লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডক্টর সিনহা এম এ সাঈদ বলেন, ‘আপনার কাজ দিয়ে প্রমাণ করুন, আস্থা অর্জন করুন সবার। নির্বাচনের সময় কতটুকু নিরপেক্ষ ভ‚মিকা পালন করতে পারেন সংশয় রয়েছে। আমি আশাবাদী মানুষ।’

নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্রের ধরন, কেমন নির্বাচন হবে; এ নিয়ে বিদ্যমান আইন বিধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনা যায় সে বিষয়ে কাজ পরার পরামর্শ দিয়েছেন টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ডক্টর ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আইনে কোনো পরিবর্তন করা যায় কি না তা চিহ্নিত করেন আপনারা।’ সরকারের অনুগত না থেকে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রয়োজনে ইস্তফা দেবেন। সব অংশীজন, ভোটার, আমরা আপনাদের পক্ষে আছি।’

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘ভোটাররা নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েছে। ইসি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে কাজ এগিয়ে নিতে হবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ফরাস উদ্দিন জানান, ভোটের আগে- পরে ছয় মাস নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব কমিশনের কাছে থাকা উচিত। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে একাদশ সংসদের অধিবেশন থাকবে না। এ জন্য ভোটের আগে চার মাস, ভোটের পরে দুই মাস- এ ছয় মাসের জন্য ক্ষমতা ইসির হাতে থাকতে পারে। আস্থা অর্জন করতে পারলে সবাইকে নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভোট করা সম্ভব।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জানান, সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান কমিশন কিছুটা আস্থা সংকটে পড়েছে। সবার নাম প্রকাশ করেনি কমিটি। এছাড়া নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব ও আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসির দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

জোনায়েদ সাকি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার দলের নিবন্ধন দেয়ারও অনুরোধ করেন তিনি। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সাহসী পদক্ষেপ ও সত্য বলার পরামর্শ দিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘এটি কঠিন সমস্যা। দেশের বিরাট একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন বয়কট করে বেড়াচ্ছে। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব না অনেকে বলেছেন।’ সংলাপে সবার মতামত পর্যালোচনা করে অংশগ্রহণমূলক ভোট করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের আশ্বাস দেন নতুন সিইসি। ইভিএম নিয়ে বিশিষ্টজনদের পরামর্শের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘ইভিএম-এ কোনো অসুবিধা আছে কি না; মেশিনের মাধ্যমে ভোটে কোনো ডিজিটাল কারচুপি হয় কি না- এটা আমাদের দেখতে হবে। অনেকে অভ্যস্ত নন। ইভিএমের প্রতি আস্থা নিয়ে কথা উঠেছে।’ তিনি বলেন, ‘ইভিএমে ভালো দিক রয়েছে, দ্রুত গণনা হয়ে যায়। কিন্তু পুনর্গণনার সমস্যা রয়েছে; ব্যালটে পুনর্গণনা করা যায়। কারিগরি কমিটির সঙ্গে মিটিং করে আমাদের ইভিএম সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, সঠিক হলে তা চালিয়ে যেতে হবে। কাজে না লাগলে বর্জন করাই ভালো। এসব মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ধর্মকে যেন নির্বাচনে কোনোভাবে উপজীব্য না করা হয়। নির্বাচনে এটাকে কেউ কাজে না লাগায়, সেটা অবশ্যই আমরা দেখবো।’

সিইসির মতে, ‘যে দল সরকারে থাকে তাদের কিছুটা বাড়তি অ্যাডভান্টেজ থাকে। কারণ, প্রশাসন, পুলিশ সবই তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইসি তাদের ওপর কতটা নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে, আইনের কোনো অভাব নেই, কিন্তু প্রয়োগের দিক থেকে বাস্তবে ঘাটতি রয়েছে। আমরা এনফোর্সমেন্টটা যেন ভালোভাবে করতে পারি সেটা চেষ্টা করব। এনফোর্সমেন্ট ক্যাপাসিটি আরও বাড়াতে পারলে তৃণমূলে ভোটারদের মধ্যে আস্থা সৃষ্টি হয়। তাহলে কেন্দ্রে কেন্দ্রে গন্ডগোল হবে না। আমরা অনুকূল পরিবেশ পাবো।’ এ বিষয়ে সিইসি সবার সহযোগিতা চান। বৈঠকে সিইসি ছাড়াও নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আহসান হাবিব খান, বেগম রাশেদা সুলতানা ও মো. আলমগীর, ইসি সচিসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আমন্ত্রিত বিশিষ্টজনদের মধ্যে সংলাপে উপস্থিত ছিলেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ডক্টর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিন, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ডক্টর দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান (সিইউএস) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইনডিজিনিয়াস পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমেদ, নিজেরা করি’র কো-অর্ডিনেটর খুশি কবির, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, লিডারশিপ স্টাডিজ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ডক্টর সিনহা এম এ সাঈদ, সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বেগম শাহীন আনাম, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ডক্টর মোস্তাফিজুর রহমান, গভর্নেন্স অ্যান্ড রাইট সেন্টারের প্রেসিডেন্ট ডক্টর জহুরুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর শেখ হাফিজুর রহমান। আগামী ৩০ মার্চ গণমাধ্যমের সঙ্গে সংলাপে বসবে ইসি। এরপর নারী নেত্রী ও দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকে বসবে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি।

Comments (0)
Add Comment