স্টাফ রিপোর্টার: রাজপথ দখলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পাল্টাপাল্টি হুমকি দিচ্ছে। এই লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে হটিয়ে নিজেদের শক্তি জাহিরে দুপক্ষই দলীয় নেতাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এতে রাজনৈতিক উত্তেজনা রক্তক্ষয়ী সংঘাতে রূপ নেয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের রাজপথের লড়াই সামাল দিয়ে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ কৌশলী ছক এঁটেছে। ‘থ্রি মানথস্ স্ট্যাটিজিক প্ল্যানে’ (ত্রৈমাসিক কৌশলী কর্মপরিকল্পনা) গতানুগতিক ফৌজদারি মামলার তদন্ত, আসামি ধরপাকড় ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ রাখাসহ অন্যান্য রুটিন ওয়ার্ক স্বাভাবিকভাবে পরিচালনার পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনে উদ্ভুত যেকোনো বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কীভাবে তাৎক্ষণিক সামাল দেয়া যায়, এর সুবিন্যস্ত ছক রয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিক অঙ্গনে অনাকাক্সিক্ষত কোনো ঘটনা সংঘটিত হওয়ার আগেই কোন কৌশলে কীভাবে তা দ্রুত প্রতিরোধ করা সম্ভব, এর গাইডলাইনও দেয়া আছে।
অন্যদিকে রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা কিংবা সদস্য যাতে কোনো ধরনের উস্কানির ফাঁদে পা না দেন, সে ব্যাপারেও কৌশলী কর্মপরিকল্পনার ছকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। অতি উৎসাহী পুলিশ সদস্যদের দিকে তীক্ষè নজর রাখার পাশাপাশি পুলিশের নিজস্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টিতেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তাগিদ দেয়া হয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আগামী তিন মাস সবচেয়ে স্পর্শকাতর। এ সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতি যেকোনো দিকে আকস্মিক মোড় নিতে পারে। সরকার ও বিরোধী দলের মুখোমুখি অবস্থানে নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি ভয়াবহ সংঘাত-সহিংসতায় রূপ নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি নিরীহ মানুষ বিভিন্ন রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিকার হতে পারে। তাই সার্বিক বিষয় বিবেচনায় রেখে মাঠপর্যায়ের গোয়েন্দারা এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করে। এরই ধারাবাহিকতায়
‘থ্রি মানথস্ স্ট্যাটিজিক প্ল্যান’ তৈরি করা হয়েছে। এই সময়টুকু পুলিশ সফলভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সম্ভব হলে পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে।
গোয়েন্দা পুলিশের ওই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার দাবি, যথাসময় এই কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা দেশে বড় ধরনের কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সুযোগ পাবে না। সন্ত্রাসী কোনো গোষ্ঠী বিশেষ কোনো মিশন সফল করার চেষ্টা চালালেও তা ব্যর্থ হবে। এতে রাজনৈতিক অঙ্গনে সাংগঠনিক প্রতিযোগিতা থাকলেও রাজপথে সংঘাত-সহিংসতার শঙ্কা খুবই কম থাকবে। তবে রাজনৈতিক কোনো বিষয়ে পুলিশ সরাসরি হস্তক্ষেপ করবে না বলেও দাবি করেন তিনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে জানা গেছে, স্পর্শকাতর এই তিন মাস দেশের প্রতিটি থানার ফুট ও কার পেট্রোল দ্বিগুণ করা হবে। এ সময় সংশ্লিষ্ট জোনের সহকারী কমিশনার (এএসপি) থেকে আপ-ওয়ার্ড কর্মকর্তারা টহল কার্যক্রম নিয়মিত মনিটর করবেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে গোয়েন্দা নজরদারি কয়েকগুণ বাড়বে। বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন কর্মসূচিতে যারা বোমাবাজি, যানবাহনে অগ্নিসংযোগ এবং ভাঙচুরসহ বিভিন্ন ধরনের নাশকতামূলক কর্মকান্ডে সরাসরি জড়িত ছিল, তাদের সার্বিক গতিবিধি পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। যাতে পলিটিক্যাল ক্যাডার কিংবা ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা কোনো ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা চালাতে না পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে সোর্সও নিয়োগ করবে পুলিশ।
ত্রৈমাসিক কৌশলী কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, এই সময়টুকু আইনশৃঙ্খলা রক্ষার রুটিন ওয়ার্কের পাশাপাশি রাজনৈতিক বিভিন্ন ইস্যু পর্যবেক্ষণে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। কোনো আন্দোলন কর্মসূচিতে বিশৃঙ্খলা কিংবা নৈরাজ্য সৃষ্টির আশঙ্কা থাকলে, তা সামাল দিতে পুলিশকে সর্বোচ্চ আগাম প্রস্তুতি রাখার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনরা যাতে রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রেখে দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে, সে জন্য তাদের গতিবিধিও পর্যবেক্ষণে রাখবে পুলিশ। পাশাপাশি কারাবন্দি টপ টেরররা যাতে এ সময় জামিনে মুক্তি না পায়, আইনগত সে তৎপরতা অব্যাহত রাখার পরিকল্পনাও রয়েছে।
অন্যদিকে এই তিন মাসে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক থাকবে পুলিশ। বিশেষ করে কেউ যাতে হয়রানিমূলক ধরপাকড়ের শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা হবে। তবে পুরনো বিভিন্ন নাশকতা মামলায় যারা জামিন না নিয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন, কিংবা সাজা মাথায় নিয়ে পলাতক রয়েছেন, তাদের দেখামাত্র গ্রেপ্তার করা হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেয়া হবে না।
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৩-৪ মাস আগে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। তবে এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কেননা, দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এখনো নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। বরং নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা না হলে তারা কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে সাফ জানান দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে অটল থেকে তারা সরকার পতন আন্দোলনে রয়েছে। অন্যদিকে সরকারি দলও মাঠে সক্রিয়। এ অবস্থায় পুলিশকে আগাম প্রস্তুতি রাখতে হচ্ছে।
এদিকে এই কৌশলী কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কবে নাগাদ দেশের সব থানা পুলিশকে নির্দেশনা দেয়া হবে, সে সম্পর্কে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কোনো স্পষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাতেই এই ‘ছক’ জেলা পুলিশ সুপারদের (এসপি) হাতে পৌঁছে যাবে। তারা তা থানা পুলিশকে অবহিত করবেন। একই সময় মেট্রোপলিটন কমিশনারদের মাধ্যমে দেশের সব মহানগরের আওতাভুক্ত থানাগুলোকে নির্দেশ দেয়া হবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কলাবাগান থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) সাইফুল ইসলাম জানান, ‘থ্রি মানথস্ স্ট্যাটিজিক প্ল্যান’ এর লিখিত নির্দেশনা না পেলেও এরই মধ্যে তারা এ ব্যাপারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে মৌখিকভাবে অবহিত হয়েছেন। সে অনুযায়ী তারা আগামী দিনের ডিউটি চার্ট ও আনুষঙ্গিক কার্যক্রমের ছক তৈরি করছেন। খুব শিগগিরই তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হবে।