স্টাফ রিপোর্টার: সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত প্রস্তুতির দোরগোড়ায় বিএনপি। বিভাগীয় সমাবেশ শেষেই সরকার পতনের এক দফায় যাবে। এ লক্ষ্যে চূড়ান্ত করা হচ্ছে আন্দোলনের রূপরেখা। দলটি এবার অনেকটাই ১৯৯১ ও ২০০১ সালের বিরোধী দলের কৌশলকে অনুসরণ করছে। ওই সময় বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যেভাবে আন্দোলন করেছিল বিএনপিও ঠিক একই ছকে এগোচ্ছে। আন্দোলনের দাবি-দাওয়া ও কর্মসূচির অনেক ক্ষেত্রেই রয়েছে মিল। শুধু তাই নয়, দল দুটির নেতাদের বক্তব্যেও রয়েছে সাদৃশ্য। তখন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা প্রদান, সংসদ থেকে পদত্যাগ, যুগপৎ কর্মসূচির মধ্যদিয়ে বৃহত্তর ঐক্য সৃষ্টি করে রাজপথে জোরালো আন্দোলন সৃষ্টি করেছিল আওয়ামী লীগ। বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে দুটি আন্দোলনেই বলতে গেলে সফলতা পায় দলটি। শুধু রাজপথের আন্দোলন নয়, শরিকদের নিয়ে একসঙ্গে নির্বাচন এবং পরে সরকারও গঠন করেছিল বর্তমান ক্ষমতাসীনরা।
বিএনপির এবারের আন্দোলনের ছক অনেকটাই আওয়ামী লীগের মতো। সরকার হটাতে চলছে বৃহত্তর ঐক্য গঠনের কাজ। বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিগগিরই দেওয়া হবে আন্দোলনের রূপরেখা। ’৯৬-এর আদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে দলটি। সংসদ থেকে পদত্যাগের নীতিগত সিদ্ধান্তও নিয়েছে। আন্দোলনে সফলতা এলে শরিকদের নিয়ে নির্বাচনি জোটের কথাও ভাবা হচ্ছে। নির্বাচনে জয়ী হলে মিত্রদের নিয়ে গঠন করা হবে জাতীয় সরকার।
আওয়ামী লীগের মতো বিএনপিও প্রাথমিকভাবে ৯ দফা দাবিতে মাঠে নেমেছে। এসব দাবি নিয়ে বিভাগীয় গণসমাবেশ করছে বিএনপি। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় করা হবে মহাসমাবেশ। ওই সমাবেশকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা। কী ঘোষণা আসছে মহাসমাবেশ থেকে। দলের একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, সমাবেশ থেকে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা থাকবে। তবে সরকার পতনের কোনো আলটিমেটাম দেওয়ার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে জনগণ জেগে উঠেছে। চট্টগ্রামের গণসমাবেশে তা প্রমাণিত হয়েছে। সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার। তারা কখন যাবে, সেটাই আমাদের লক্ষ্য। তবে দিনক্ষণ চূড়ান্ত করে কোনো আন্দোলন হয় না। যারা এটা বলে তাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞতা আছে কিনা সন্দেহ।
তিনি বলেন, অতীতে কোন দল কীভাবে আন্দোলন করেছে সেদিকে আমাদের নজর নেই। আন্দোলনের নিজস্ব একটা গতি আছে। দলের সিদ্ধান্ত মতো তা চূড়ান্ত করা হয়।
১৯৯১ সালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে বিএনপি। বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ভালোই চলছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালের মার্চে মাগুরা উপনির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগের পর তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরে। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তাই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সোচ্চার হতে থাকে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। জাতীয় পার্টি, জামায়াতসহ সরকারবিরোধী আরও কয়েকটি দল নিয়ে এ ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় হয় তারা। ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। এ দাবিতে আন্দোলন জোরালো করতে এক পর্যায়ে সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ওই বছর ২৮ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের ১৪৭ জন সংসদ-সদস্য স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। পরে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দল ছাড়া একতরফা নির্বাচন করে বিএনপি। কিন্তু আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়। সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ প্রস্তাবিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন করার পদ্ধতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৯৪ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যে পদ্ধতিতে রাজপথে আন্দোলন করে সফল হয়, বিএনপিও অনেকটা সে পথেই হাঁটছে। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে আওয়ামী লীগ যে দাবিতে রাজপথ উত্তপ্ত করেছিল বিএনপি এখন ঠিক একই দাবি জানিয়ে আসছে। দেওয়া হচ্ছে নানা কর্মসূচি। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ফর্মুলা দিয়েছিল বিএনপি এখন সেটাই সংবিধানে সংযোজনের দাবি জানাচ্ছে। ১৯৯৬ সালের ত্রয়োদশ সংশোধনীর আলোকেই নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এ নিয়ে একটি খসড়া তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি এনপিপির সঙ্গে সংলাপ শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা আপনারা সময়মতো জানবেন। যুগপৎ আন্দোলন শুরু করলে আপনারা জানতে পারবেন। আমাদের রূপরেখায় থাকবে সংবিধানের ৫৮(খ), (গ) যেটা সংবিধানের (ত্রয়োদশ সংশোধনী) ছিল। তারই আলোকে এই রূপরেখা হবে।’
শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা নয়, আওয়ামী লীগের মতোই জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। ইতোমধ্যে দলের পক্ষ থেকে সংসদ-সদস্যের পদত্যাগের ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে। তবে শিগগিরই তারা সংসদ থেকে পদত্যাগ নাও করতে পারেন। দলটির একাধিক নেতা জানান, এই মুহূর্তে পদত্যাগ করলে সরকার এসব আসনে উপনির্বাচন করতে পারে। তাই এমন সময় পদত্যাগ করবে যখন উপনির্বাচন করার সুযোগ থাকবে না।
জানতে চাইলে বগুড়া-৬ থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ-সদস্য জিএম সিরাজ বলেন, সংসদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও স্থায়ী কমিটি যেদিন সিদ্ধান্ত জানাবে সেদিনই আমরা পদত্যাগ করব।
প্রায় একই সুরে কথা বলেন বিএনপির সংরক্ষিত আসনের সংসদ-সদস্য ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের পতনে জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। এ লক্ষ্যে দল যদি আমাকে সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে বলে তাতে আমি প্রস্তুত আছি।
২০০১ সালে নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট। সরকার গঠনের পর থেকেই আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেয় তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে রাজপথে সক্রিয় থাকে তারা। ২০০৪ সালের রাজপথের আন্দোলন ধীরে ধীরে বেগবান করা হয়। ২০০৫ সাল থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐক্যের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ। এ লক্ষ্যে ১১ দল, জাসদ (ইনু) ও ন্যাপের (মোজাফ্ফর) সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে একটা সমঝেতায় পৌঁছেন তারা। আলাদাভাবে বৈঠক করে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের সঙ্গেও। পরে একই ইস্যুতে যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশনের সংস্কার, স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন, দ্রব্যমূল্য মানুষের নাগালের মধ্যে রাখাসহ ৯ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ২০০৫ সালের ১৮ নভেম্বর যুগপৎ কর্মসূচি ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ, ১১ দল, জাসদ ও ন্যাপ। দাবি আদায়ে ১১ ডিসেম্বর টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত এক ঘণ্টার গণঅনাস্থা প্রাচীর কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে এক পর্যায়ে গঠন করা হয় ১৪ দলীয় জোট। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি ক্ষমতা ছাড়ার পর আন্দোলন আরও তীব্র করে দলটি। ১৪ দলের পাশাপাশি সরকারবিরোধী মহাজোট গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। জাতীয় পার্টি, জেপি, তরিকত ফেডারেশন নিয়ে গঠন করা হয় মহাজোট। পরে একসঙ্গে নির্বাচন এবং সরকারও গঠন করে তারা।
২০০৪ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যে কৌশলে আন্দোলন করেছিল বিএনপি কর্মসূচির ছকেও সে প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারবিরোধী বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ করছে বিএনপি। এসব সংলাপে সব দলই যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। শিগগিরই ঘোষণা করা হবে যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা। বিএনপিসহ মিত্র দলগুলো একসঙ্গে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করবে। শুধু তাই নয়, আন্দোলনে সফল হলে মিত্রদের নিয়ে একটা নির্বাচনি জোট করার ব্যাপারেও আলোচনা চলছে। নির্বাচনে জয়ী হলে আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।
শুধু আন্দোলনের কর্মসূচি নয়, সভা-সমাবেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের দেওয়া বক্তব্য-বিবৃতিতেও রয়েছে সাদৃশ্য। ২০০৬ সালের ৩ এপ্রিল ছাত্রলীগের এক সম্মেলনে সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘দুর্নীতিবাজ, অত্যাচারী, খুনি, জঙ্গি সরকারকে জনগণ আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। একই বছর ১২ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক বক্তব্যে শেখ হাসিনা সংস্কার প্রস্তাব তুলে ধরে বলেছিলেন, ‘সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিকে প্রধান উপদেষ্টা করতে হবে। ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিইসি নিয়োগ দিতে হবে।’ ওই সময় বিএনপি সরকারের উদ্দেশে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা বলেছেন, ‘উন্নয়নের জোয়ারে দেশ ভাসছে বলে বলা হচ্ছে। তাহলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে ভয় কিসের। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই সময় বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সংবিধানের ভেতর থেকেই আলোচনা হতে পারে।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে থাকা মাঠের বিরোধী দল বিএনপি নেতাদের বর্তমান বক্তব্য অনেকটা আওয়ামী লীগের ওই সময়ের বক্তব্যের সঙ্গে মিল রয়েছে। বিএনপি নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন, ‘দুর্নীতিবাজ, ফ্যাসিস্ট সরকারকে মানুষ আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। এখনো সময় আছে পদত্যাগ করুন। না হলে পালানোর পদ পাবেন না। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই পদত্যাগ করে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিন। ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি নেতাদের সুরে আওয়ামী লীগের নেতারা এখন বলছেন, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।