স্টাফ রিপোর্টার: আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন আজ শনিবার। সকাল সাড়ে ১০টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবারের জাতীয় সম্মেলনে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় তুলে ধরা হবে। বিষয়টি সামনে রেখেই সম্মেলনের সেøাগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়।’ আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা বলছেন, সম্মেলনের মাধ্যমে আসা নতুন নেতৃত্বের প্রধান চ্যালেঞ্জ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। তাদেরই নির্বাচনী বৈতরণীতে নেতৃত্ব দিতে হবে। সে যাত্রায় যেন কোনো নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে তা বিবেচনায় রেখেই হবে নেতা নির্বাচন। পাশাপাশি নির্বাচন সামনে রেখে সম্মেলন থেকেই জানানো হবে-আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দেবেন দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগ এক ও অভিন্ন এবং বাঙালি জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আওয়ামী লীগের ইতিহাস মানে বাঙালি জাতির সংগ্রাম ও গৌরবের ইতিহাস। দেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলটি ১৯৪৯ সালে রোজ গার্ডেনে জন্ম নেয়। দেশের সুদীর্ঘ রাজনীতি এবং বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এই দল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই এ দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা লড়াই, সংগ্রাম, চড়াই-উতরাই পেরিয়ে দলটি এখন রাষ্ট্রক্ষমতায়। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটির সামনে এখন প্রধান লক্ষ্য আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া।
সাদামাটাভাবে আয়োজন: বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কৃচ্ছ সাধনের লক্ষ্যে এবারের সম্মেলন সাদামাটাভাবে আয়োজন হচ্ছে। আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ জাতীয় সম্মেলন দুই দিনব্যাপী হয়েছে। এবার তা একদিনেই শেষ হবে। সর্বশেষ ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছিল। ওই বছরের ২০-২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সম্মেলনের বাজেট ছিলো ৩ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এবার প্রায় ৩০ লাখ টাকা ব্যয় কমিয়ে সম্মেলনের বাজেট ধরা হয়েছে ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকা। এবারের জাতীয় সম্মেলনে সারাদেশ থেকে প্রায় সাত হাজার কাউন্সিলর এবং লক্ষাধিক নেতাকর্মী অংশ নেবেন। এ বছর বিদেশিদের দাওয়াত দেয়া হয়নি। তবে সম্মেলনে কেন্দ্রীয় ১৪ দল, জাতীয় পার্টি, বিএনপিসহ নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দলকে দাওয়াত দিয়েছে আওয়ামী লীগ। সম্মেলনে আসা প্রায় ৫০ হাজার মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
যেভাবে সম্মেলন শুরু : সকাল সাড়ে ১০টায় সম্মেলনস্থলে এসেই শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে এবং জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করে সম্মেলন উদ্বোধন করবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। পরে কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ে মঞ্চে যাবেন তিনি। তিনি মঞ্চে যাওয়ার পর আধা ঘণ্টা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হবে। এরপর শোক প্রস্তাব উত্থাপন করবেন দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া। সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ওবায়দুল কাদের। স্বাগত বক্তব্য দেবেন অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শেষ হবে। দিনব্যাপী সম্মেলনের প্রথম পর্ব শেষে নামাজ ও খাবারের বিরতির পর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে শুরু হবে কাউন্সিল অধিবেশন। সেখানেই নির্বাচিত হবেন আওয়ামী লীগের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।
নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া : দ্বিতীয় পর্ব কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী লীগের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হবে। উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও প্রবীণ আইনজীবী ইউসুফ হোসেন হুমায়ুনকে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনের অপর দুই সদস্য-প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান এবং উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব গ্রহণের আগে বর্তমান কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সভাপতির আসন ছেড়ে কাউন্সিলরদের জন্য নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসবেন। শুরু হবে নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া। নির্বাচন কমিশন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থিতা ঘোষণা করবেন। প্রথমে দলটির দুজন প্রবীণ নেতা সভাপতি পদে নাম প্রস্তাব ও সমর্থন করবেন। একাধিক প্রার্থী না থাকলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সভাপতি নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। একই প্রক্রিয়ায় নির্বাচন করা হবে সাধারণ সম্পাদক।
রয়েছে ভোটের প্রস্তুতি : সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে একাধিক কোনো প্রার্থী না থাকলে প্রস্তাবিত দুজনকেই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত ঘোষণা করবেন নির্বাচন কমিশন। যদিও ব্যালট পেপার, স্বচ্ছ ব্যালট ও নির্বাচন কমিশন সব প্রস্তুত। তবে এবারও এর ব্যবহারের সম্ভাবনা কম। কারণ অন্যান্য বারের মতো এবারও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই থাকছেন এটা মোটামুটি নিশ্চিত। কাউন্সিলররা সর্বসম্মতি দিয়ে তাকেই যে টানা দশমবারের মতো আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করবেন সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। তাকেই দায়িত্ব দেবেন সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য নেতা নির্বাচনের।
অন্যান্য বারের মতো এবারের সম্মেলনেও সর্বত্র আলোচনা চলছে, কে হচ্ছেন পরবর্তী সাধারণ সম্পাদক-তা নিয়ে। টানা দুই মেয়াদের দায়িত্ব পালনের পর আবারও ওবায়দুল কাদেরই এ পদে থাকবেন কিনা? নাকি নতুন কেউ আসবেন? তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর। তিনি আস্থা রাখলে এ পদে হ্যাটট্রিক করবেন ওবায়দুল কাদের।
রেওয়াজ অনুযায়ী, সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক মূলমঞ্চে উঠে পরবর্তী কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করবেন। এরপর বাকি পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নির্বাচনের দায়িত্ব কাউন্সিলররা শেখ হাসিনার ওপরই অর্পণ করবেন। তাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠনের চাবিকাঠি দলের প্রধানের হাতেই রয়েছে। অনুমাননির্ভর নানাজনের নাম এলেও নীতিনির্ধারকরা বলছেন, প্রবীণ-নবীনের সংমিশ্রণে নতুন নেতৃত্ব গঠিত হবে। তবে এবারের সম্মেলনে বড় ধরনের চমক থাকছে না। কালকের কাউন্সিল অধিবেশনেই অধিকাংশ পদে মনোনীত নেতাদের নাম ঘোষণা করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কৌতূহল বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নিয়ে: এদিকে গত সম্মেলনের মতো এবারও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরসূরি শেখ রেহানা, সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল এবং রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে ঘিরে চলছে নানামুখী আলোচনা। তাদের মধ্যে কেউ এবার কেন্দ্রীয় কমিটিতে আসছেন কিনা এ নিয়ে দলে এবং দলের বাইরে রয়েছে যারপরনাই কৌতূহল। বৃহস্পতিবার রাতে ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা সজীব ওয়াজেদকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে সম্মেলনে আমন্ত্রণপত্র হস্তান্তরের ছবিটি ভাইরাল হওয়ার পর এ আলোচনার মাত্রা আরও দীর্ঘতর হয়। সম্মেলনে গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্রে তেমন পরিবর্তন আসছে না। বাড়ছে না দলের আকার; বড় পরিবর্তন আসছে না কেন্দ্রীয় কমিটিতেও।
নৌকার আদলে মূল মঞ্চ : মহান বিজয়ের মাসে আয়োজিত এ সম্মেলনে নৌকার আদলে তৈরি হয়েছে মূলমঞ্চ। সেই নৌকার মাঝখানে বসবেন সম্মেলনের প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। মঞ্চের পেছনের ব্যানারে শোভা পাচ্ছে পদ্মা সেতু। তারপর রয়েছে জাতীয় স্মৃতিসৌধ, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট। স্মৃতিসৌধের বামপাশে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ছবি। তার বামে উড়ছে জাতীয় পতাকা। তার বামে আছেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। এছাড়া বামে আরও আছে মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শামসুল হক এবং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ছবি।
বঙ্গবন্ধু পরিবার ও জাতীয় চার নেতার ছবি : অন্যদিকে স্মৃতিসৌধের ডানপাশের একটি ছবিতে সাদা পায়রা ওড়াচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার ডানে আছে বোন শেখ রেহানা ও বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্রী সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। তারও ডানে আছে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানের ছবি। উদ্যানের লেকপাড়েও করা হয়েছে প্যান্ডেল। ওই প্যান্ডেলেও দেয়া হয়েছে ৩টি বড় স্ক্রিন। সেখানে চেয়ারগুলো এমনভাবে সাজানো হয়েছে যেন পেছনের কারও কোনো অসুবিধা না হয় স্ক্রিন দেখতে। এদিকে সম্মেলন ঘিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুরো এলাকায় শতাধিক সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।
পোস্টার-ফেস্টুনে শুভেচ্ছা : এদিকে সম্মেলন ঘিরে উদ্যান ও আশপাশের এলাকায় ব্যানার, ফেস্টুন ও বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। মৎস্যভবন থেকে শাহবাগ পর্যন্ত রাস্তাজুড়ে শোভা পাচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি। পাশাপাশি লাগানো হয়েছে আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের চিত্রসংবলিত ফেস্টুন। এছাড়া সম্মেলনস্থলে সরকারের বিভিন্ন মেগা প্রকল্পের ফেস্টুন ও উন্নয়নের ছবি রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন সড়কেও সম্মেলনকে স্বাগত জানিয়ে ফেস্টুন টানিয়েছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বৃহস্পতিবার রাতে ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে সম্মেলনের থিম সং আপলোড করা হয়েছে। দপ্তর বিভাগের উদ্যোগে নবনির্মিত ‘থিম সং’ যুক্ত করেছে নতুন মাত্রা।