স্টাফ রিপোর্টার: দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরই বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে শিশু, কিশোর ও তরুণরা গৃহবন্দি। ঘরের চার দেয়ালের মধ্যেই কাটছে তাদের দিন-রাত। বন্দি ঘরে কী করছে তরুণরা? কীভাবে কাটছে তাদের সময়? অন্তত ১০ জন অভিভাবক ও তরুণের সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। অধিকাংশই বলেছেন, পড়ার বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক নেই বললেই চলে। লেখাপড়ায় মনোযোগ নেই আগের মতো। পুরো সময় কাটছে টিভি দেখে আর স্মার্ট ডিভাইসে। দিন-রাতের রুটিন বদলে গেছে। অনেকের আচার ব্যবহারেও এসেছে পরিবর্তন। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অভিভাবকেরা।
এই অবস্থা চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের সামনের দিনগুলো কেমন হতে পারে? জানতে চাইলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রত্যেকটি মানুষের শরীরে যেমন পুষ্টি দরকার, তেমনি মস্তিষ্কেরও পুষ্টি দরকার হয়। মস্তিষ্কের পুষ্টি হলো ভালো চিন্তা। সারাদিন ফেসবুক-ইউটিউবে থাকলে মস্তিষ্কের সৃজনশীলতা নষ্ট হয়ে যায়। চিন্তায় পরিবর্তন আসে। ভালো চিন্তা বাদ দিয়ে খারাপ চিন্তাগুলো মস্তিষ্কে ভর করে। আচরণ পালটে যায়, মানুষের সঙ্গে ব্যবহারও খারাপ হতে থাকে। ফলে এখনই শিক্ষক ও অভিভাবকদের বিশেষ নজর দিতে হবে তরুণ শিক্ষার্থীদের দিকে।’
একজন অভিভাবক জাকির-উল ইসলাম সঙ্গে আলাপকালে বলছিলেন, ‘আমার ছেলে আমির-উল ইসলাম একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ দ্বিতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। ছুটির এই পুরো সময়টাতে আমরা চেষ্টা করেও ওকে বইয়ের কাছে নিতে পারিনি। সারাদিন রুমে বসে হয় ল্যাপটপে নতুবা মোবাইল ফোনে মাথা গুঁজে থাকে। এখন সে ভোররাতে ঘুমাতে যায়, বিকেলে ঘুম থেকে ওঠে। ওর কোনো কাজে বাধা দিলেই মায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। কেমন যেনো খিটমিটে স্বভাবের হয়ে গেছে ছেলেটা।’
একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানালেন ব্যাংক কর্মকর্তা জিয়াউল ইসলাম। তার ছেলে জহিরুল ইসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একটি বিভাগে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে। জিয়াউল বলছিলেন, ‘অধিকাংশ সময়ই ছেলের সময় কাটে নিজের রুমে। সেখানে কী করে কিছুই জানি না। এখন বড়ো হয়েছে, বেশি হস্তক্ষেপ করলে মাইন্ড করে। কিন্তু বইপত্র ছেড়ে দিয়ে সারাদিন ফেসবুক নিয়ে থেকে ওর যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটা আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু কী করবো?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, ‘সত্যি বলতে কি, আমরা শিক্ষকরা এখনো ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা হতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ। স্কুল পর্যায়ে অনলাইনে কিছু ক্লাস হচ্ছে, এটা ভালো দিক। আমি আমার শিক্ষার্থীদের নিয়ে সত্যি উদ্বিগ্ন। প্রতিটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পৃথক ফেসবুক গ্রুপ আছে। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোনও আছে। পড়াশোনা বাদ দিলাম, ওই গ্রুপগুলোতেও যদি আমরা ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে আড্ডা দিতাম, তাহলেও কিন্তু তাদের মানসিক অবস্থাটা কিছুটা হলেও ভালো রাখা যেতো। আমি বলবো, শিক্ষার্থীদের রক্ষায় আমাদের শিক্ষকদের কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।’
ব্যবসায়ী আহমেদুল হক। তার স্ত্রী ফারহানা হক একটি স্কুলের শিক্ষক। আলাপকালে ফারহানা বলেন, ‘আমার ছেলে জুম্মন সাদিকুল হক কলেজে পড়ে। বন্ধের এই সময় বাসাতেই আছে। যেহেতু কলেজের বই পড়ার আগ্রহ কম, তাই আমার লাইব্রেরিতে থাকা বই থেকে একটা করে গল্পের বই ওকে দিই। ওর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে প্রতিটি বই পড়া শেষ হলে ২০০ টাকা দেবো। এভাবে সে কিছু বই পড়া শেষ করেছে। এছাড়া আমরা রাতে একসঙ্গে বসে সিনেমা দেখি। আসলে আমি ওকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। তারপরও দিনের অনেকটা সময় মোবাইল ফোনে কাটায়। এখন যে কী করবো ভাই?’
এমন অসংখ্য অভিভাবক তাদের সন্তানদের নিয়ে চিন্তার মধ্যে আছেন। করোনাকালীন অধিকাংশ শিক্ষার্থীর সময় কাটছে মোবাইল, ল্যাপটপ আর টিভি দেখে। অনেক তরুণ ভিডিও গেমে আসক্ত হয়ে পড়েছে এমন কথাও জানালেন অনেক অভিভাবক। এমনকি সারাদিন ইন্টারনেটে থেকে পর্নোগ্রাফির দিকে ঝুঁকছে অনেক তরুণ।
বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতির সভাপতি ও শিশু হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন বলেন, ‘এখনকার তরুণরা বেশ সেনসেটিভ। তাদের খুব একটা বিরক্ত না করাই ভালো। আবার তাদের লেখাপড়ার মধ্যেও রাখতে হবে। টিভি দেখা বা ঘরের মধ্যে অন্য ধরনের খেলাধুলার (লুডু, দাবা, ক্যারাম) ব্যবস্থা করতে হবে। বাবা-মা সন্তান মিলে খেলতে হবে। এখন আপনি যদি নিজেই সারাদিন মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকেন, তাহলে তো আপনার সন্তানও তা-ই করবে! সন্তানকে সময় দেয়ার এটা কিন্তু একটা ভালো সুযোগ। সেটার সদ্ব্যবহার করতে হবে।’