স্টাফ রিপোর্টার: রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে সারাবিশ্বেই জ্বালানি সরবরাহে বিরাট এক সংকট তৈরি হয়েছে। জ্বালানি সরবরাহের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গত কয়েকদিন ধরে লোডশেডিং চলছে। ফলে জনভোগান্তি তীব্র আকার ধারণ করার পাশাপাশি শিল্প কারখানায়ও উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। যা সাম্প্রতিককালে দেখা যায়নি। সামনে এর তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পাবে সরকারের উচ্চ মহল থেকে আভাসও পাওয়া গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পরিস্থিতির জন্য বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রীর দুঃখ প্রকাশের পর স্থানভিত্তিক লোডশেডিংয়ের সময় বেধে দেয়ার কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত কয়েকদিনে লোডশেডিং ঘিরে সংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় জ্বালানি বিশ্লেষকরা পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগেই সরকারকে জ্বালানি সাশ্রয়ে বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে। প্রয়োজনে রাতের একটা সময় কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ পুরোপুরি বন্ধ রাখা ও বাড়ি-ঘরে বিদ্যুতের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার বন্ধে সবাইকে সাশ্রয়ী কথাও সামনে আসে। এমনি পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি লোডশেডিংয়ের ক্ষেত্রে এলাকাভিত্তিক সময় নির্ধারণ করে দেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়ে নিজের পরিকল্পনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এখন আমরা একটা সুনির্দিষ্ট সময় যদি ধরে দিই, যে একেক এলাকাভিত্তিক, যে কিছুক্ষণের জন্য সেখানে বিদ্যুতের কিছু লোডশেডিং হবে হঠাৎ যাবে, হঠাৎ আসবে- (এমন) না, মানুষ প্রস্তুতি নিতে পারবে। সেভাবেই আমাদের কিছু কিছু পদক্ষেপ এখন থেকেই যদি আমরা নিই, তাহলে আগামী দিনে যে আরও সমস্যাটা দেখা দিচ্ছে, সেটার থেকে আমরা নিজেদের রক্ষা করতে পারব।’
এদিকে বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে সারাবিশ্বেই জ্বালানি সরবরাহে বিরাট এক সংকট তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়ার ওপর যেসব দেশ জ্বালানি নির্ভর ছিল, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউক্রেনের মিত্রদের নানান নিষেধাজ্ঞার কারণে সেই সংকট আরও প্রকট হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বহু দেশ সৌদি আরব, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের জ্বালানি পেতে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি আরও অনেক দেশ। তাতে চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে দামও কয়েকগুণ বেড়েছে। জ্বালানির এমন উচ্চমূল্য অনেক দেশের কাছেই বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। যে কারণে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর পক্ষে এই মুহূর্তে বেশি দামের জ্বালানি কেনা সম্ভব হচ্ছে না। সংকটের এই চক্রে বাংলাদেশও ভুক্তভোগী। ফলে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছে দেশের বিদ্যুৎ খাত। দাম বেড়ে যাওয়ায় তরলিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) নির্ভর এবং ডিজেল চালিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। এ কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বারবার লোডশেডিং করতে হচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগকে।
দেশের বিভিন্ন স্থানের খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার চলছে। কোনো কোনো গ্রামে সারাদিনেও এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ হয়নি। মঙ্গলবার দিনে ১২ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ছিল দশ হাজার ৮৩১ মেগাওয়াট। আর সন্ধ্যায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন ছিল ১২ হাজার ২৩৬ মেগাওয়াট। এর আগে সোমবার দেশে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ছিল। এর বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের মতো। সরকারি হিসাবে লোডশেডিং সাড়ে ১২শ’ মেগাওয়াট বলা হলেও বাস্তবে এটি আড়াই হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেছে বলে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলো সূত্রে জানা গেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেওয়া হয় ৯৮ কোটি ঘনফুট গ্যাস। গ্যাস সংকটে প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হয়েছে। সরকারি তথ্যমতে, ৮১০ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে সারা দেশে। তবে বিতরণ কোম্পানিগুলোর হিসাবে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট।
দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের রেকর্ড হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল রাতে। এ সময় সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট। এর আগের রেকর্ড ছিল ১২ এপ্রিল। ওইদিন ১৪ হাজার ৪২৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। তারপরও কেন লোডশেডিং? এমন প্রশ্ন উঠেছে।
শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটের দিনের অধিকাংশ সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো বিদেশে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি অর্ডার বাতিলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। অথচ গত রোববার রপ্তানি উন্নয়ন ব্য্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে (২০২১-২২) ৫ হাজার ২০৮ কোটি ৭ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ১৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। বিরাট এ সাফল্য অর্জনের পর উদ্যোক্তারা আরও এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেও বর্তমান পরিস্থিতি বজায় থাকলে সব সম্ভাবনাই ম্লান হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।