রাজনৈতিক সংঘাতের শঙ্কায় সতর্ক পুলিশ : দেশজুড়ে গোয়েন্দা তৎপরতা

 

স্টাফ রিপোর্টার: রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে কেউ যাতে রাজপথে নেমে জ্বালাও-পোড়াও, ভাঙচুর, রাস্তা বন্ধ করে সভা-সমাবেশ, যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা কিংবা অগ্নিসংযোগসহ কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে; সে জন্য সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পুলিশকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। দেশজুড়ে গোয়েন্দা তৎপরতাও বাড়ানো হচ্ছে। ফুট ও কার পেট্রোল এবং চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি অভিযান জোরদার করারও প্রস্তুতি চলছে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে জঙ্গিরা যাতে কোনোভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে এজন্য পুলিশের প্রতিটি ইউনিটকে সতর্ক করা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

পুলিশের এআইজি পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তা জানান, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, লোডশেডিং ও নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে আন্দোলনের নামে তা-ব চালাতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছে। যার কিছু আলামত এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। তাই ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া কেউ যাতে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে না পারে, সে জন্য পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছে।

এদিকে সংঘাত সহিংসতার ঘটনা রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু ঢাকাতেই বেশি ঘটতে পারে বলে সরকার আশঙ্কা করছে। এর প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর পুলিশকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের বক্তব্যে এ তথ্যের সত্যতা উঠে এসেছে। বৃহস্পতিবার ডিএমপি হেডকোয়ার্টার্সে সেপ্টেম্বর-২০২২ মাসের মাসিক অপরাধ পর্যালোচনায় তিনি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সংঘাতের শঙ্কা প্রকাশ করে পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেছেন, সামনের দিনগুলোতে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে সংঘাত বাড়াতে কিছু মানুষ কাজ করবে, তাদের বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। দেশের থানাগুলোতে কোনো নিখোঁজ জিডি হলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গিবাদ হঠাৎ যাতে মাথাচাড়া দিয়ে কোনো ঘটনা ঘটাতে না পারে, সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক পরিস্থিতি তারা সার্বক্ষণিক নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচিতে তারা কোনো ধরনের বাধা দেবে না। বরং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিও সহনশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করার চেষ্টা করবে। তবে সভা-সমাবেশ কিংবা বিক্ষোভ মিছিলের নামে কোনো রাজনৈতিক সংগঠন তা-ব চালানোর চেষ্টা করলে তা যাতে কঠোরভাবে দমন করা যায় তার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হবে। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচিতে কোনো ধরনের তা-ব চালানোর আগাম তথ্য পাওয়া গেলে গোটা এলাকা কর্ডন করে রাখা হবে। ওইসব স্পটে রায়ট কার, জলকামান ও দাঙ্গা ফোর্স মোতায়েন রাখারও আগাম নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে পুলিশের অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) পুলিশ সুপার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে দীর্ঘদিন ধরে ঘাপটি মেরে থাকা জঙ্গিরা আবারও সংঘটিত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো কিছু জঙ্গি সংগঠনের মধ্যে মতাদর্শের ভিন্নতা বা দ্বন্দ্ব থাকলেও শক্তি-সক্ষমতা প্রদর্শনের স্বার্থে তারা একজোট হচ্ছে। একসঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন ব্যানারে তৎপরতা চালানোর ছক আঁটছে।

গোয়েন্দাদের তথ্যানুযায়ী, জঙ্গি সংগঠন হুজি, জেএমবি, এবিটি এবং আনসার আল ইসলাম মিলে কথিত ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামের নতুন সংগঠন গঠন করেছে। এ সংগঠনের ব্যানারে ৫৫ জন তরুণ ‘হিজরতের’ উদ্দেশ্যে নিরুদ্দেশ হয়েছে। এদের মধ্যে অন্তত ৩৮ জনই বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ)’ তত্ত্বাবধানে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে বলে গোয়েন্দারা অনুমান করছে। তাই কোনো পরিবার থেকে কোনো তরুণ বা যুবক নিখোঁজ হলেই তা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখতে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের সঙ্গে কখন কার যোগাযোগ ছিল তা-ও যাচাই করার তাগিদ রয়েছে।

প্রশাসনিক সূত্রগুলো জানায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর মাত্র ১৩/১৪ মাস বাকি নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই সরকার আগেভাগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছে।

তবে সরকারের এ ‘স্ট্যাটিজিক প্ল্যানে’ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের অহেতুক হয়রানি-নির্যাতনের কোনো ছক নেই বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের ঊর্ধ্বতনরা দাবি করেন। তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, সাম্প্রদায়িক শান্তি বিনষ্টে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র বানচাল, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে সৃষ্ট নৈরাজ্য ঠেকিয়ে নির্বাচনী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই অ্যাকশন প্ল্যানের আওতায় রাজপথে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী অস্ত্রধারী পলিটিক্যাল ক্যাডারদের ধরপাকড় করা হবে। বিশেষ করে নানা উসকানিতে দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার মিশনে নামা ভয়ংকর ষড়যন্ত্রকারী চক্র এবং এর নেপথ্য মদদদাতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ‘অ্যাকশনে’ নামার ছক তৈরি করা হয়েছে।

এদিকে রাজনৈতিক সংঘাত, সহিংসতা ও নাশকতা ঠেকাতে পুলিশের হার্ডলাইনে নামার নির্দেশ পাওয়ার বিষয়টি থানার ওসিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, রাজনৈতিক যেসব ক্যাডারদের বিরুদ্ধে রাজপথে বোমাবাজি, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগসহ নানা ধরনের তান্ডব চালানোর অভিযোগ রয়েছে তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। বাড়ানো হচ্ছে তাদের ওপর নজরদারি। বিশেষ করে রাজনৈতিক কর্মসূচির আগে-পরে তাদের গতিবিধি কঠোরভাবে মনিটর করা হচ্ছে। তাদের সন্দেহজনক কর্মকান্ড দেখামাত্র তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। এছাড়া রাজনৈতিক মামলা ও ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়ানো পলিটিক্যাল ক্যাডারদের গ্রেপ্তারে ওপরমহলের জোরালো তাগিদ রয়েছে।

Comments (0)
Add Comment