স্টাফ রিপোর্টার: মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে সিন্ডিকেটের পর এবার বিমানের টিকিট বিক্রিতেও সিন্ডিকেটের থাবা পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যার ফলে ঢাকা-কুয়ালালামপুর রুটের ওয়ানওয়ে একটি টিকিটের মূল্য নির্ধারিত দামের প্রায় তিনগুণ বেশি দিয়েও মিলছে না। শুধু টিকিটের দাম বৃদ্ধি নয়, আগামী ১৫ দিনে ঢাকা-মালয়েশিয়া রুটে চলাচলকারী কোনো এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটেই আসন খালি নেই বলে ট্র্যাভেল এজেন্সিগুলোর মালিকরা জানিয়ে দিয়েছেন।
বিমানের টিকিট সঙ্কটের কারণে দেশটিতে শ্রমিক যাওয়ার গতি কমছে বলে মনে করছেন অভিবাসন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা। তারপরও নতুন করে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক যাওয়া শুরু হওয়ার পর গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্য বিভিন্ন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে ৫০ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এর মধ্যে ডিসেম্বর মাসেই গিয়েছে পৌনে ২১ হাজার শ্রমিক। গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার পর অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) মহাসচিব আবদুস সালাম আরেফ মালয়েশিয়াগামীদের টিকিট সঙ্কট থাকা প্রসঙ্গে বলেন, ঢাকা-কুয়ালালামপুরগামী ওয়ানওয়ে একটি টিকিটের দাম যেখানে ৩০ হাজার টাকা ছিল। সেই টিকিটের দামই এখন ৭০ হাজার টাকা দিয়েও কেনা যাচ্ছে না। শুধু তাই নয়, আগামী ১৫ দিন পর্যন্ত এই রুটে কোনো টিকিট নেই বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, যাত্রীর চাহিদার কারণে চাপ আছে। তবে একটা টিকিটের দাম এভাবে কি কারণে বাড়ছে সেটা আমাদের সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর খতিয়ে দেখতে পারেন। গত বছর (২০২২) সিন্ডিকেটের মাধ্যমে খুলবে নাকি ওপেন ফর অল (সবাই) মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে শ্রমিক যাবে এ নিয়ে দুই দেশের এজেন্সি মালিকদের নিয়ে চলে অনেক নাটকীয়তা। অবশেষে জল্পনার অবসান ঘটিয়ে এমওইউ চুক্তি ও মালয়েশিয়া সরকারের ইচ্ছানুযায়ী চিহ্নিত ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সির সমন্বয়েই গঠিত সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমবাজার উন্মুক্তের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। দাতো আমিন নুর গংদের নিয়ে ২৫ এজেন্সির গঠিত ওই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শ্রমবাজার উন্মুুক্ত হলেও যথাসময়ে কাক্সিক্ষত শ্রমিক বাংলাদেশ থেকে যেতে পারেনি। কারণ সিন্ডিকেটের অতিরিক্ত চার্জ। তার আগেই মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী কোম্পানিগুলো তাদের শ্রমিক সঙ্কট কাটাতে পার্শ্ববর্তী দেশ নেপাল, ফিলিপাইনসহ অন্যান্য সোর্স কান্ট্রিভুক্ত দেশ থেকে কর্মী নিয়ে ফেলে। ফলে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক যাওয়ার হার তুলনামূলক অনেক কম গেছে বলে জনশক্তি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা জানিয়েছেন। এরপরও মালয়েশিয়া সরকার ২৫ সিন্ডিকেটের সাথে সম্প্রতি আরো ৫০টি এজেন্সিকে কাজ করার সুযোগ করে দেয়। পরবর্তীতে চাপে পড়ে আরো ২৫টি এজেন্সির নাম যুক্ত করে মোট ১০০টি এজেন্সিকে চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেয়। এসব সিন্ডিকেট করার পেছনে শত শত কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে (হুন্ডি) বিনিয়োগ হয়েছে বলে জনশ্রুতি রয়েছে। আর শ্রমবাজারে সিন্ডিকেট হওয়ার কারণে দেশ থেকে সরকার নির্ধারিত ৮০ হাজার টাকার বিপরীতে পাঁচ গুণ অতিরিক্ত টাকা খরচ করেই শ্রমিকদের মালয়েশিয়ায় যেতে হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব প্রসঙ্গে সাধারণ রিক্রুটিং এজেন্সির মালিকরা বলছেন, মালয়েশিয়ার দাতো আমিনের সিস্টেমের টাকা, বিমানের টিকিটের দাম আকাশচুম্বী, মেডিক্যাল পরীক্ষা ও বিএমইটির অতিরিক্ত খরচ ছাড়াও নানা কারণে তাদেরকে বেশি টাকা দিয়েই শ্রমিক পাঠানোর কাজ সারতে হচ্ছে। এখন পরিস্থিতি এমন হয়েছে বিমানের যে ওয়ানওয়ে টিকিটের দাম আগে ৩০ হাজার টাকা ছিল সেটি এখন তাদেরকে কিনতে হচ্ছে ৭০ হাজার টাকা দিয়ে। তাও পাওয়া যাচ্ছে না। তারপরও ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার কারণে বেশি দামে টিকিট কিনেই শ্রমিকদের নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফ্লাইট দেয়া হচ্ছে।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যার পর বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শফিউল আজিম বলেন, ঢাকা মালয়েশিয়া রুটের ফ্লাইটগুলোতে এখন ডিমান্ড বেশি। চাহিদা বাড়ার কারণে নিয়মিত ফ্লাইটের বোয়িং-৭৩৭) পাশাপাশি বোয়িং-৭৭৭ দিয়ে অতিরিক্ত আরো ৩টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আমার বিমানের এমডি পদে যোগদানের আজ এক মাস হলো মাত্র। এরই মধ্যে আমি বিমানের সার্বিক বিষয়গুলো দেখছি পজিটিভলিই এগোচ্ছে। যেখানে সমস্যা আছে সেগুলো উভয়পক্ষকে নিয়ে বসে আমি ঠিক করে দিচ্ছি। যার ফলে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি। কানাডা ফ্লাইটের ব্যাপারে এমডি বলেন, খুব ভালো সাড়া পাচ্ছি। তারপরও কিছু মিডিয়ায় আমাদের নিয়ে কিছু নেগেটিভ সংবাদ প্রকাশ হচ্ছে। যা দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। কাজের স্পৃহা হারিয়ে ফেলছি, যা মোটেও কাম্য নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গতকাল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মার্কেটিং অ্যান্ড সেলসের একজন দায়িত্বশীল বলেন, বর্তমানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ছাড়াও ইউএস বাংলা, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, এয়ার এশিয়া, মালিন্দো এয়ার নিয়মিত ফ্লাইট চালাচ্ছে। এর মধ্যে বিমানের প্রতিদিন বোয়িং-৭৩৭ দিয়ে একটি করে ফ্লাইট চলছে। টিকিটের দাম তিন গুণ কেন জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক, স্টুডেন্টসহ অন্যান্য পেশার লোকজনের চাহিদা থাকায় টিকিটের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর জন্য আমরা ইতোমধ্যে নিয়মিত ফ্লাইটের পাশাপাশি অতিরিক্ত আরো তিনটি ফ্লাইট চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা ১৫ জানুয়ারি, ২২ জানুয়ারি ও ৩ ফেব্রুয়ারি চলবে। এসব ফ্লাইট বোয়িং-৭৭৭ দিয়ে চালাব। এর সিট ক্যাপাসিটি ৪১৯। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এসব ফ্লাইটের টিকিট সিস্টেম আমরা ওপেন করে দিয়েছি। ক্রেতারা সময় পাচ্ছেন ২ ঘণ্টা। যদিও ওপেন করার ৫ মিনিটের মধ্যে টিকিট নাই হয়ে যাচ্ছে। তার ধারণা টিকিট সিস্টেমে দেয়ার সাথে সাথে এজেন্সিগুলো টিকিট কেটে ফেলছে। তিনি বলেন, আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি, মালয়েশিয়াগামী বিমানের কোনো ফ্লাইটের সিট ব্লক করা হচ্ছে না। সবকিছুই ওপেন।
গতরাতে আটাবের একজন সদস্য বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারের মতো বিমানের টিকিটও সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে। যার কারণে শ্রমিক পাঠানোর জন্য নির্ধারিত দামের তিন গুণ টাকায় টিকিট কিনতে বাধ্য হচ্ছে এজেন্সিগুলো। শুধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স নয়, অন্যান্য এয়ারলাইন্সেরও একই অবস্থা। এ বিষয়ে তদন্ত করে কতিপয় সিন্ডিকেটের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া উচিত বলে মনে করছেন প্রবাসী বাংলাদেশীসহ সংশ্লিষ্টরা। নতুবা মালয়েশিয়াগামী বিশেষ করে শ্রমিকদের অভিবাসন ব্যয় প্রতিনিয়ত বাড়তেই থাকবে।