ঝালকাঠির সুগন্ধার দুই তীরে পোড়া গন্ধ : দগ্ধ ৭৫, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শোক
স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকা-বরগুনা নৌরুটের বরগুনাগামী ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চের ইঞ্জিনরুম থেকে সৃষ্ট ভয়াবহ অগ্নিকা-ে আগুনে পুড়ে এবং প্রাণ রক্ষায় নদীতে লাফিয়ে পড়ে ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। অগ্নিদগ্ধ এবং লাফিয়ে পড়ার সময় আহত হয়েছে ৭৫ জন। লঞ্চে থাকা শিশু ও মহিলাসহ নিখোঁজ রয়েছে আরো অর্ধশতাধিক যাত্রী। নিহতদের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। রাষ্ট্রপতি মো: আব্দুল হামিদ ও মালদ্বীপ সফররত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন।
গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের গাবখান চ্যানেলের আশপাশে এ দুর্ঘটনা ঘটে। লঞ্চটিতে প্রায় ৫০০ জন যাত্রী ছিলো বলে জানা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা ও ঝালকাঠির কোস্টগার্ড সদস্যরা। সুগন্ধা নদীর পাড়ে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই স্বজনের খোঁজে এসেছেন। তাদের আহাজারিতে সুগন্ধার তীরের বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। একটি লাশ উদ্ধার হলেই স্বজনরা ঝাঁপিয়ে পড়ছেন প্রিয়জনের খোঁজে।
বরিশাল ফায়ার সার্ভিস ও কোস্ট গার্ড জানিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ৪৫ জনের লাশ পাওয়া গেছে। দগ্ধ অবস্থায় ৭০ জনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আরো অনেক নিখোঁজ রয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের পাঁচটি ইউনিট উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে, পুরো লঞ্চটি পুড়ে গেছে। লঞ্চে থাকা প্রত্যক্ষদর্শী সাবেক লঞ্চ কেরানি গোবিন্দসাহা জানান, এ লঞ্চে পাঁচ শতাধিক যাত্রী থাকলেও আগুনে ১০০-১৩০ জন দগ্ধ হয়েছেন। তার ধারণা, দগ্ধকৃত যাত্রীর মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় শতাধিক হতে পারে।
এদিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠি সদরের ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের গাবখান চ্যানেলে এমভি অভিযানের ইঞ্জিন রুমে আগুন লাগে। দ্রুতই তা পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়লে প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দেন। লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাচ্ছিলো। এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, লঞ্চে শিশু, বুড়ো, নারীসহ ৫০০’র বেশি যাত্রী ছিলো। খবর পাওয়ার পরপরই উদ্ধারকাজ শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও স্থানীয়রা। তবে, কুয়াশার কারণে উদ্ধারকাজে অনেকটাই বেগ পেতে হচ্ছে। এ দিকে আহত ৭০ জনকে উদ্ধার করে স্থানীয় ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে নেয়া হলে সেখান থেকে অনেককে উন্নত চিকিৎসার জন্য বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।
জানা যায়, লঞ্চের দোতলা ও তিনতলায় কেবিনের প্রবেশপথ লঞ্চ যাত্রা শুরুর পরপরই বন্ধ করে দেয়া হয়। নিচের যাত্রীরা নদীতে লাফিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচালেও কেবিনের যাত্রীরা বের হতে পারেননি। অগ্নিকা-ের সংবাদ পেয়ে ঝালকাঠি বরিশাল থেকে ১৬টি অগ্নিনির্বাপক গাড়ি ছুটে আসে। তবে সকাল ৯টা পর্যন্ত লঞ্চে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, লঞ্চে অগ্নিকা-ের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি। এদিকে, নিখোঁজ যাত্রীদের তথ্য দিতে পারছে না বরগুনা নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ঝালকাঠি সদর উপজেলার গাবখান ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের গাবখান চ্যানেলের কাছে সুগন্ধা নদীর মাঝখানে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে লঞ্চটি। কতজন নিখোঁজ আছে, সে তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। ঘটনার পর থেকে স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে লঞ্চে থাকা যাত্রীদের। তাই তাদের খোঁজে বরগুনা নৌবন্দরে এসেছেন লঞ্চে থাকা যাত্রীদের স্বজনরা। কিন্তু এখানে এসে কোনো তথ্যই মিলছে না। নিখোঁজ যাত্রীদের তথ্য দেয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই বরগুনা নৌবন্দরে।
বরগুনা নৌবন্দরের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ জানান, লঞ্চটিতে ৪০০-৫০০ যাত্রী পরিবহন করতে পারে। তাদের উদ্ধারে বরিশাল নৌবন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। তবে অগ্নিকা-ের ঘটনার পরপরই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সাথে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ঝালকাঠি ইউনিটের যুব সদস্যরা উদ্ধারকাজে সহযোগিতা করে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে যুক্ত হয়েছে কোস্টগার্ডসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। ইতোমধ্যে বরগুনা জেলা প্রশাসন থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক সার্বিকসহ কয়েকজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ঘটনাস্থলে গেছেন।
বেঁচে ফিরে আসা সাংবাদিক সানাউল্লাহ জানান, লঞ্চটি ঝালকাঠি টার্মিনালের কাছাকাছি পৌঁছলে ইঞ্জিনরুমে আগুন লেগে যায়। সেই আগুন মুহূর্তেই পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে যায়। তিনি নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে তীরে উঠেছেন বলে জানান। এ দুর্ঘটনার কবল থেকে বরগুনায় ফিরে এসেছে শহরের ক্রোক এলাকার বাসিন্দা রাজু আহমেদ, ছেলে হৃদয় (১২), মিম (৫), স্ত্রী মমতাজ, শহরের কাঠপট্টি এলাকার ছেলে মীর ফাইয়াজ, বন্ধু আশিক আহমেদ, রাইসুল আকরাম।
বরগুনার বেতাগী উপজেলার কাউনিয়া সিকদার বাড়ির রিনা বেগম (৩৮) ও তার মেয়ে লিমা (১৪) নিখোঁজ রয়েছে। তবে লিমা বেগমের ছেলে কাউনিয়া এমদাদিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র রনি (১৫) লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। বর্তমানে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এছাড়া বরগুনার অধিকাংশ যাত্রীই বরগুনা সদর উপজেলার ফুলঝুরি, বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ী, বামনা উপজেলার রামনা, পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়াসহ বিভিন্ন এলাকার এখনো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছেন।
বর্তমানে ঘটনাস্থলে উদ্ধারকাজ চালমান রয়েছে। উদ্ধার তৎপরতায় রয়েছেন ফায়ার সার্ভিস, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্টের ঝালকাঠি যুব সদস্য, কোস্টগার্ড ও পুলিশ সদস্যরা। তবে সচেতন মহল বলছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় এমন ধরনের দুর্ঘটনার মূল কারণ। কিভাবে ইঞ্জিনরুমের পাশে রান্নাঘর থাকে? আবার সেখানে বড় বড় গ্যাস সিলিন্ডারে রান্না করা হয়! বিষয়গুলো সত্যিই ভাবার বিষয়। এছাড়া অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা কতটা পরিপূর্ণ তাও খতিয়ে দেখা উচিত। এ নিয়ে নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের ব্যবস্থা না থাকায় এসব দুর্ঘটনা বারবার ঘটছে। স্বজন হারানোর ব্যথার কান্না করতে হচ্ছে অনেকেরই। মহলটি আরও বলছে, সরকারের তরফ থেকে সঠিক তদন্ত সাপেক্ষে এমন ঘটনার স্থায়ী সমাধান করলে আর কখনো এ দুর্ঘটনা দেখতে হবে না।
গতকাল শুক্রবার ভোর ৬টার দিকে ঝালকাঠির কলেজ খেয়াঘাট এলাকায় নদী থেকে ১৩ বছরের এক কিশোরীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তার মা জানান, তারা ঢাকা থেকে বরগুনার উদ্দেশে মা ও মেয়ে এক সাথে লঞ্চে উঠেছিলেন। কিন্তু আগুন লাগার পর মেয়েকে পাওয়া যায়নি। খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে মেয়ের লাশ পেয়েছেন।
চাঁদপুর থেকে বরগুনাগামী লঞ্চের যাত্রী মো: মোহসীন বলেন, ‘রাত ৩টার দিকে হঠাৎ নিচ থেকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখি। এরপর আগুনের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় আমি তিনতলা থেকে লাফ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যাই।’
ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘আমি দোতলায় ঘুমিয়ে ছিলাম। আগুনের তাপে ঘুম ভেঙে দেখি পুরো লঞ্চটিতে আগুন ধরে গেছে। তখন লাফ দিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেই।’ ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক মো: জোহর আলী জানান, এখন পর্যন্ত ৭৫ জন আহত যাত্রীকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হতাহতদের পরিচয় এখনও নিশ্চিত করা যায়নি।
পাথরঘাটা ইউএনও স্ত্রীসহ আহত: ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চের যাত্রী বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হোসাইন মোহাম্মদ আল মুজাহিদ ও তার স্ত্রী ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন । ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলায় সুগন্ধা নদীতে প্রবেশের পর এ ভয়াবহ অগ্নিকা-ের দুর্ঘটনা ঘটে। বর্তমানে তারা ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ইউএনও দম্পতি লঞ্চের ভিআইপি কেবিন নীলগিরির যাত্রী ছিলেন। অগ্নিকা-ের ঘটনায় লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়ার সময় তার স্ত্রী উম্মুল ওয়ারার ডান পা ভেঙে গেছে। বর্তমানে তিনি ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। শুক্রবার সকালে বরগুনা জেলা প্রশাসক মো: হাবিবুর রহমান এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আহত ইউএনও জানান, ঢাকা থেকে অফিসিয়াল কাজ সেরে বৃহস্পতিবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যা ৬টার দিকে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে বরগুনার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। রাত ৩টার দিকে লঞ্চে অন্য যাত্রীদের চিৎকারে তার ঘুম ভাঙে। এসময় লঞ্চটি সুগন্ধা নদীর মাঝখানে অবস্থান করছিলো। অনেকেই নদীতে লাফিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন লঞ্চ থেকে তারাও লাফ দিলে তৃতীয় তলা থেকে দোতলায় পড়ে যান। তখন তার স্ত্রী উম্মুল ওয়ারার ডান পা ভেঙে যায় এবং হাতেও প্রচ- আঘাত পান। তিনি আরও বলেন, লঞ্চে থাকা বৃদ্ধ এবং শিশুরাই বেশি হতাহত হয়েছেন। এছাড়া লঞ্চে অনেক নারী ছিলেন, যারা নদীতে লাফিয়ে পড়েছেন।
রাষ্ট্রপতির শোক : রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ঢাকা থেকে বরগুনাগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি অভিযান-১০’ এ আগুনে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। গতকাল এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপ্রধান নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। রাষ্ট্রপতি হামিদ আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর শোক: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে বরগুনাগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমভি অভিযান-১০’ এ আগুনে হতাহতের ঘটনায় গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে মালদ্বীপ সফররত শেখ হাসিনা গতকাল এক শোক বার্তায় নিহতদের রূহের মাগফিরাত কামনা এবং আহতদের আশু আরোগ্য কামনা করেন। শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী নিহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
নিহতদের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা সহায়তার ঘোষণা: ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে দেড় লাখ টাকা সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গতকাল শুক্রবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ ব্যক্তিদের দেখার পর সাংবাদিকদের এ কথা জানান প্রতিমন্ত্রী।
এ দিকে বরগুনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, নিহতদের লাশ দাফনে প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে। জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান শুক্রবার গণমাধ্যমকে বলেন, যেহেতু লঞ্চটি বরগুনায় আসছিলো, নিহত ও আহতদের অধিকাংশ এ জেলার বাসিন্দা হবেন। নিহতদের প্রত্যেকের পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা করে আর আহতদেরকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা আমরা জেলা প্রশাসন থেকে দেবো।