স্টাফ রিপোর্টার: মর্মান্তিক নৌ-দুর্ঘটনায় প্রাণ গেল দুই শিশুসহ অন্তত ছয়জনের। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীতে পণ্যবাহী বড় আকারের জাহাজ রূপসী-৯ এর আকস্মিক ধাক্কায় এমএল আশ্রাফ উদ্দিন নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে যায়। মর্মান্তিক ওই ঘটনায় ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে দুজন পুরুষ ও বাকি দুজন নারী রয়েছেন। এছাড়া নিখোঁজ রয়েছে প্রায় ২০ যাত্রী। প্রাণহানির সংখ্যা আরও বাড়তে পারে-এমন আশঙ্কা ফায়ার সার্ভিস, নৌপুলিশসহ সংশ্লিষ্টদের। হতাহতের বেশির ভাগেরই বাড়ি মুন্সিগঞ্জ জেলায়। রোববার দুপুর আড়াইটার দিকে নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুরের আল আমিন নগর এলাকায় অসংখ্য মানুষের চোখের সামনেই ঘটে এই নৌদুর্ঘটনা। এ খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়লে নিখোঁজদের সন্ধান ও মারা যাওয়াদের লাশ নিতে নদীর পাড়ে ভিড় জমান স্বজনরা। তাদের বুকফাটা আর্তনাদে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। তাদের আহাজারিতের ভারী হয়ে ওঠে শীতলক্ষ্যা নদীর দুই পাড়। আঘাতাকারী রূপসী-৯ জাহাজটি সিটি গ্রæপের মালিকানাধীন বলে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদশীরা জানান, নারায়ণগঞ্জের সৈয়দপুরের আল আমিন নগর এলাকায় অসংখ্য মানুষের চোখের সামনেই ঘটে এই নৌদুর্ঘটনা। ঘটনার পরপরই আশপাশের মানুষ সাঁতার কাটতে থাকা যাত্রীদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন। পরে সরকারের অন্যান্য সংস্থাগুলো পৌঁছায়। ওই ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ নৌবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, নৌপুলিশ, কোস্টগার্ডের সদস্যরা উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সংস্থাগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে উদ্ধার কার্যক্রম মনিটরিং করেন। দুর্ঘটনার দুই ঘণ্টার মধ্যেই নদীর তলদেশে লঞ্চটি শনাক্ত করে ফায়ার সার্ভিস। তবে উদ্ধারকারী জাহাজ আশপাশে না থাকায় রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত এ লঞ্চটি উদ্ধার করতে পারেনি এসব সংস্থা। তবে আঘাতকারী রূপসী-৯ জাহাজ ও এর চালকদের মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে আটক করেছে নৌপুলিশ। এ ঘটনায় নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহণ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন পৃথক তিনটি কমিটি গঠন করেছে।
বেঁচে যাওয়া যাত্রী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, এমএল আশ্রাফ উদ্দিন নারায়ণগঞ্জ থেকে যাত্রী নিয়ে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে যাওয়ার সময়ে পেছন থেকে দ্রুতগতিতে আসা রূপসী-৯ জাহাজটি আকস্মিকভাবে ধাক্কা দিতে থাকে। ধাক্কায় ধাক্কায় লঞ্চটি বাম দিকে কাত হয়ে ধীরে ধীরে ডুবে যায়। এ সময় লঞ্চে থাকা যাত্রীদের অনেকেই জীবন বাঁচাতে নদীতে লাফিয়ে পড়েন। আশপাশের নৌযান থেকে তাদের বয়া দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। কাছাকাছি থাকা নৌকা ও ট্রলার তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যায়। লঞ্চে অর্ধশত যাত্রী ছিল জানান বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা। তবে লঞ্চটি ঘাট থেকে ছেড়ে আসার সময়ে সেটিতে ৩৪ জন যাত্রী ছিল বলে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরে দেয়া ভয়েজ ডিক্লারেশনে উল্লেখ করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী ওই এলাকার নৌকার মাঝি সৈয়দ আলী জানান, ‘আমি দ‚র থেকে দেখলাম বড় জাহাজটা যাত্রীবোঝাই লঞ্চটারে ধাক্কা দিতে দিতে ডুবাইয়া দিল। কিছু লোক লাফ দিয়া পানিতে পড়তে পারলেও ভিতরের যাত্রীরা নদীতে লাফাইতে পারে নাই। তারা লঞ্চসহ নিচে তলাইয়া গেছে। কয়েকজন হয়তো ডুব দিয়া উঠতে পারছে কিন্তু বেশিরভাগই নদীর নিচে ডুইব্বা গেছে।’ সাঁতরে বেঁচে যাওয়া লঞ্চের একজন নারী যাত্রী বলেন, ‘হঠাৎ করে দেখি পেছন থেকে কে যেন বারবার ধাক্কা দিচ্ছে। একপর্যায়ে লঞ্চটিতে পানি উঠতে শুরু করে। অনেক মানুষ জীবন বাঁচাতে চিৎকার করছিল। শিশুরা কাঁদতেছিল। কোনো উপায় না দেখে আমি লাফাইয়া নদীতে পড়ি।’
এদিকে দুর্ঘটনাকে হত্যাকাণ্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ-সদস্য মৃণাল কান্তি দাস। দুর্ঘটনার পরই ঘটনাস্থলে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করেন তিনি। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যাত্রীবাহী লঞ্চটি অন্যান্য দিনের মতোই এদিনও যাত্রী নিয়ে যাচ্ছিল। আকস্মিকভাবে পেছন থেকে পণ্যবাহী জাহাজটি উঠিয়ে দিলে লঞ্চটি ডুবে যায়। ওই সময়ে লঞ্চে ৭০-৮০ জন যাত্রী ছিল বলে শুনেছি। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, কার্গো জাহাজটি বেপরোয়াভাবে চলেছে। কারণ এটি যাদের মালিকানাধীন তাদের অনেক টাকা। তারা বিত্তবৈভবের মালিক, তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করে। এ ঘটনায় অবহেলার অভিযোগ এনে মামলা করা হলে তাদের কিছুই হবে না-তা চালকও জানে। মৃণাল কান্তি দাস বলেন, যেভাবে এসব মানুষ মারা হলো, সেই ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের করে তাদের সাজা দেওয়া সম্ভব হলে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব হবে।
রোববার যে স্থানে এমন নৌদুর্ঘটনা ঘটেছে কাছাকাছি স্থানে এর আগেও নৌদুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়।। নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা কুদরত-ই-খোদা জানান, গত বছর এপ্রিল মাসে আল আমিন নগর সেতুর কাছাকাছি এসকেএল-৩ নামের একটি কার্গো জাহাজের ধাক্কায় সাবিত আল হাসান নামের একটি ছোট লঞ্চ ডুবে যায়। ওই ঘটনায় ৩৫ জন মারা যান। গত তিন সপ্তাহ আগে বালুবাহী একটি নৌযানের ধাক্কায় দুই পাড়ে চলাচলকারী একটি নৌকা উলটে একজনের মৃত্যু হয়। তিনি জানান, ওই এলাকায় নদী সরু হওয়া, পণ্য ও যাত্রীবাহী নৌযানের আধিক্য থাকায় এমন দুর্ঘটনা ঘটে আসছে।
বিআইডব্লিউটিএ ও নৌপরিবহণ অধিদপ্তর স‚ত্রে জানা গেছে, লঞ্চটি ১টা ৫৮ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সীগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। এটি একটি সানকেন ডেকবিশিষ্ট লঞ্চ। এ লঞ্চের তলদেশ চিকন থাকায় অল্প ধাক্কায় ডুবে যায়। সারা দেশে এ ধরনের লঞ্চ রয়েছে শতাধিক। এ লঞ্চটির দৈর্ঘ্য ১৫ দশমিক ৮৫ মিটার, প্রশস্ততা ৪ দশমিক ১১ মিটার ও গভীরতা এক দশমিক ৩৭ মিটার। এক ইঞ্জিনবিশিষ্ট লঞ্চটিতে ধারণ ক্ষমতা ৬০ জন। লঞ্চটি ১৯৭৩ সালে নির্মিত। এটি ৪৯ বছরের পুরোনো লঞ্চ। অপরদিকে রূপসী-৯ কার্গো জাহাজটি উপক‚লীয় এলাকায় চলাচলকারী একটি নৌযান। এটি নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের নৌবাণিজ্য অফিসে নিবন্ধিত।