মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব ও মেয়াদ পাঁচ বছরই চায় বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার: মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর ‘কর্তৃত্ব’ বাতিলের প্রস্তাব দিয়েছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। তবে, মন্ত্রিসভায় প্রধানমন্ত্রীর কর্তৃত্ব থাকার পক্ষে বিএনপি। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদের মেয়াদ পাঁচ বছরের পরিবর্তে চার বছর করার প্রস্তাবেরও বিরোধিতা করে দলটির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মেয়াদ পাঁচ বছরই থাকা উচিত। গতকাল মঙ্গলবার সংসদ ভবনে এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে তৃতীয়দিনের আলোচনায় বিএনপি এই অবস্থান তুলে ধরে। বেলা ১১টায় এই আলোচনা শুরু হয়। মাঝখানে বিরতি দিয়ে চলে সন্ধ্যা পৌণে সাতটা পর্যন্ত। বিরতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর পক্ষে বিএনপি। আমরা চাই কিছু ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর বাইরেও তিনি (রাষ্ট্রপতি) সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য রাখার প্রস্তাবে একমত পোষণ করেছেন তারা। টানা দুই মেয়াদে কোনো ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকলে পরে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না- সংস্কার কমিশনের এমন প্রস্তাবে একমত নয় বিএনপি। দলটির মতে, টানা দুই মেয়াদের পর বিরতি দিয়ে আবার একই ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। একই ব্যক্তি সংসদ নেতা, প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় প্রধান হতে পারবেন না বলে সংস্কার কমিশন যে সুপারিশ করেছে- সেটির সঙ্গেও ভিন্নমত পোষণ করে দলটি বলেছে, এই তিনটি পদে একই ব্যক্তি থাকতে পারবেন। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ তিন বিচারপতির মধ্য থেকে একজনকে প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগের বাধ্যবাধকতা রাখার বিষয়ে মত দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, রাষ্ট্রপতির অভিশংসন প্রক্রিয়ায় পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোটের বিষয়ে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। ন্যায়পাল নিয়োগের বিষয়েও একমত হয়েছে বিএনপি। সংস্কার কমিশনের অধিকাংশ সুপারিশের সঙ্গে বিএনপি একমত- একথা জানিয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সংবিধানের অষ্টম, নবম, দশম, দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর পূর্বের অবস্থার কথা বলেছেন তারা। ধর্মনিরপেক্ষতা বিলুপ্ত করার সঙ্গে বিএনপি একমত। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার আনার ক্ষেত্রেও তারা একমত। এগুলো মৌলিক অধিকারে আনার কথা বলেছে বিএনপি। সালাহউদ্দিন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সংসদ নেতার পদ থাকা উচিত। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত যে- দলের প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী একই ব্যক্তি হবেন কিনা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় প্রতীক ব্যবহার করা যাবে না, এবিষয়ে তারা একমত। স্থানীয় প্রশাসনে যে চারটি বিভাগের কথা বলা হয়েছে, সেবিষয়েও তারা একমত। তিনি জানান, পার্লামেন্ট হবে দ্বি-কক্ষবিশিষ্ট, নি¤œকক্ষে ৪০০ আসন থাকবে, এর মধ্যে নারীদের জন্য ১০০ আসন রাখা এবং উচ্চকক্ষে ১০০ আসনের সুপারিশের বিষয়ে বিএনপি একমত। আলোচনায় সালাহউদ্দিন আহমদের সঙ্গে অংশ নিয়েছেন বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাঈল জবিউল্লাহ, আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল ও সাবেক সচিব আবু মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও সফর রাজ হোসেন এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দারও বৈঠকে অংশ নেন। গতকালের বৈঠকে সংবিধান, বিচার বিভাগ, নির্বাচন ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে আলোচনা হয়। সন্ধ্যা সাতটায় বৈঠক শেষে সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল’ বা এনসিসি গঠনের প্রস্তাবে বিএনপি একমত নয়। কারণ, রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত। এ অবস্থায় একাধিক কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি হলে দেশে দ্বৈতশাসন ব্যবস্থা তৈরি হবে বলে মনে করে দলটি। তিনি বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়ে প্রথম প্রস্তাবক বিএনপি। আমরা আগেই ৩১ দফা প্রস্তাব দিয়েছি। এখন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনও একই বিষয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, জনপ্রশাসনের বিষয়ে কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ২০৮টি সুপারিশ রয়েছে। এর মধ্যে ১৮৭টিতে একমত হয়েছে বিএনপি। একমত নয় ১১টিতে ও আংশিক একমত ৫টিতে। নির্বাচন ব্যবস্থা সংক্রান্ত ২৪৩টি প্রস্তাবের মধ্যে ১৪১টিতে একমত বিএনপি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, দুর্নীতি দমন সংক্রান্ত ২০টি প্রস্তাবের ১১টিতে একমত। বাকি ৭-৮টির বিষয়ে নীতিগত একমত। আমরা চাই, দুদক সর্বোচ্চ কার্যকর হোক। কারণ গত কয়েক বছর জনগণ দুর্নীতির যাঁতাকলে পিষ্ট। তিনি বলেন, আমরা চাই- বিচার বিভাগ স্বাধীন থাকুক। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা হোক। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে যেন সঠিক বিচার নিশ্চিত হয়। বিচারকদের বয়স ৭০ বছর করার কথা বলেছে কমিশন। আমরা বিষয়টি আরও বিবেচনা করার কথা বলেছি। কারণ হঠাৎ বিষয়টি সামনে আসলে অন্যান্য সেক্টরের কর্মকর্তারাও বয়স নিয়ে দাবি তুলতে পারেন। সালাহউদ্দিন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি আগের মতোই থাকবে কিনা, সেবিষয়ে কথা হয়েছে। বিচারপতি খায়রুল হক বলেছিলেন, আরো দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখতে। যদিও তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে, তার রায়কে আমরা অবৈধ বলেছি। তারপরও বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনার কথা বলেছি। তিনি বলেন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৪৫ সংশোধন করে শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীর আওতাধীন আইনি কাঠামোর পরিবর্তে অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা দরকার। সংবিধানে বহুত্ববাদের বিপক্ষেও রয়েছে বিএনপি। রাষ্ট্রধর্ম, ভাষা, প্রতিকৃতি প্রবর্তন, নাগরিকত্ব, সংবিধান বিরতি ও স্থগিতকরণ ইত্যাদি অপরাধ (অনুচ্ছেদ-৭ (ক) এবং ৭ (খ)) বিলুপ্তিকরণ বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবের সাথে আমরা একমত। এর আগে বৈঠকের বিরতিতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই কমিশনে যেসব সিদ্ধান্ত হবে, তা জাতীয় জীবনে মহান ভূমিকা রাখবে বলে সাংবাদিকদের জানান সালাহউদ্দিন। বিএনপির এই নেতা বলেন, আমরা আইনসভা দ্বিকক্ষ-বিশিষ্ট রাখার পক্ষে। যেখানে নি¤œকক্ষের ৪০০ আসনের মধে প্রত্যক্ষ ভোটে ১০০ আসনের এমপি হবেন নারী। দুজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন বিরোধীদল থেকে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদেও থাকবে বিরোধী দলের অগ্রাধিকার। তাছাড়া সংসদ সদস্যরা কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের পদে থাকতে পারবেন না বলেও আমরা প্রস্তাব দিয়েছি। জ্যেষ্ঠতম বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশ করেছিল বিচারব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। এতে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপি। এ বিষয়ে সালাহউদ্দিন বলেন, রাষ্ট্রে আগে কিছু অসঙ্গতি দেখা গেছে। সর্বক্ষেত্রে যদি নির্দিষ্ট করে দেই, তা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণকর হবে না। অন্তত একটি বিকল্প থাকা উচিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, উপদেষ্টাম-লীর সদস্য ১৪ জন হবেন, এতে বিএনপি একমত। উপদেষ্টাম-লী রুটিন দায়িত্ব পালন করবে, এতেও বিএনপি একমত। প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করলে, উপদেষ্টা ম্ললীর সদস্য থেকে একজনকে মনোনীত করা হবে, এ সুপারিশেও একমত। গতকাল বিএনপির সঙ্গে আলোচনার শুরুতে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, নিঃসন্দেহে আমরা একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তে উপস্থিত আছি। বিএনপির সঙ্গে আলোচিত বিষয়ে কিছু সামঞ্জস্য ও মতানৈক্য উভয় আছে। এসব বৈঠকের আলোচিত বিষয়গুলো প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করা হচ্ছে এবং তিনি এবিষয়ে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন নতুন প্রস্তাব এসেছে, সেসব নিয়ে আমরা ঐকমত্য কমিশন নিজেদের সঙ্গে আলাপ শুরু করেছি। এখন সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যা আলোচনা হচ্ছে, তা প্রাথমিক পর্যায়ের আলোচনা। দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনায় ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন কমিশনের সহ-সভাপতি।