আহত ও আতঙ্কিত যাত্রীদের আর্তনাদে কেঁপে ওঠে চার পাশ : আলাদা দুটি তদন্ত কমিটি গঠন
স্টাফ রিপোর্টার: কিশোরগঞ্জের ভৈরবে যাত্রীবাহী ট্রেনে মালবাহী ট্রেনের ধাক্কায় অন্তত ২০জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। এ সময় যাত্রীবাহী ট্রেনের চারটি বগি দুমড়ে মুচড়ে খাদে পড়ে যায়। সোমবার বেলা সোয়া ৩টার দিকে ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে এ দুর্ঘটনা ঘটে। মালবাহী ট্রেনটি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দিকে যাচ্ছিলো, আর যাত্রীবাহী আন্তঃনগর এগারসিন্ধুর গোধূলি যাচ্ছিল ভৈরব থেকে ঢাকার দিকে। স্টেশনের কন্ট্রোলরুমের ভুলের কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার পর দুটি ট্রেনের চালক, স্টেশন মাস্টার, কন্ট্রোলরুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীরা উধাও হয়ে যান। এ ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও নোয়াখালীর সঙ্গে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেন দুর্ঘটনার ঘটনায় বিভাগীয়ভাবে দুটি আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশের রেলওয়ে। রেলের পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনা তদন্ত করতে রেলওয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগ আলাদাভাবে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটিগুলোকে আগামী তিন দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীসূত্রে জানা যায়, ভৈরব রেলওয়ে জংশন স্টেশন থেকে ঢাকাগামী এগারসিন্দুর এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৩টা ৫ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। আউটার সিগন্যাল পার হয়ে ট্রেনটি যখন ঢাকার লাইনে প্রবেশ করে ঠিক তখন একটি কন্টেইনারবাহী ট্রেনকে ধীরে ধীরে চট্টগ্রাম লাইনের দিকে প্রবেশ করতে দেখা যায়। এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেসের ১৫টি বগির মধ্যে ১২টি বগি মূল লাইনে চলে যায়। এ সময় কন্টেইনারবাহী ট্রেনটি জরুরি ব্রেক দেয়। এরপরও কন্টেইনারবাহী ট্রেনটি এগারসিন্ধুরের পেছনের দিকে ধাক্কা দেয়। এ সময় চলন্ত ট্রেনটির পিছনের ২টি বগি উল্টে যায়। ঘটনাস্থলেই ১৭ জনের লাশ উদ্ধার হয়। আহতদের মধ্যে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৭৩ জনকে ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩ জন মারা গেছেন। গুরুতর আহতদের মধ্যে ৩১ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
চায়ের দোকানে বসে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন। হঠাৎ বিকট শব্দে চমকে ওঠেন তিনি। তিনি বলেন, ‘ভাত খেয়ে স্টেশনের কাছে দোকানে বসে চা পান করছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে আঁঁতকে উঠি। তাকিয়ে দেখি ধোঁয়ার কু-লি। দৌড়ে সেখানে গিয়ে দেখি দুই ট্রেনের সংঘর্ষে মানুষের আহাজারি। রেললাইনের পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে কিছু নারী-পুরুষের মরদেহ। আমি নিজেও লাশ ট্রেন থেকে বের করেছি।’ এদিকে নিহতদের মধ্যে একজনের পরিচয় মিলেছে। আফজাল হোসেন নামে নিহত যুবক ঢাকা কলেজের অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্স ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। নিহত আফজালের রুমমেট আসাদুজ্জান সুজন তার পরিচয় নিশ্চিত করেছেন।
দুর্ঘটনা কবলিত এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেসের বেঁচে যাওয়া যাত্রী ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তাকিউস সামিরা জিনান বলেন, ‘হঠাৎ জোরে ট্রেনের বগি ঝাঁকুনি দেয়। পরে শুনতে পাই আমাদের ট্রেনের দুটি বগি পড়ে গেছে। তবে তখন মনে হয়েছিল এই বুঝি সময় শেষ হয়ে এসেছে। আল্লাহর অশেষ রহমতে আমরা দুই বোন বেঁচে আছি। তখন চারদিকে শুধু চিৎকার আর আহাজারি শোনা যাচ্ছিল। পরে ট্রেন থেকে নেমে দেখি আমাদের ট্রেনের পেছনের দুটি বগি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে উল্টে আছে। সেখানে পড়ে ছিল অনেক মরদেহ।’
স্থানীয়রা জানান, ভৈরব রেলস্টেশনের আউটার পয়েন্টে ক্রসিংয়ে যাত্রীবাহী ট্রেনের শেষ চার বগিতে ধাক্কা দেয় মালবাহী ট্রেনটি। এতে যাত্রীবাহী ট্রেনের চারটি বগি উলটে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধারে এগিয়ে আসেন স্থানীয় লোকজন। পরে একে একে ফায়ার সর্ভিস, পুলিশ, র্যাব, আনসার ও বিজিবির সদস্যরা এসে উদ্ধার অভিযান শুরু করেন।
তারা জানান, দুর্ঘটনার পর এক ভয়ংকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। আহত ও আতঙ্কিত যাত্রীদের আর্তনাদে কেঁপে ওঠে চার পাশ। অক্ষত বগিগুলো থেকে যাত্রীরা হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়েন। দ্রুত বের হতে গিয়ে অনেক যাত্রী তাদের স্বজনদের হারিয়ে ফেলেন। আশপাশের এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেন দুর্ঘটনাস্থলে। এগারসিন্ধুর গোধূলি ট্রেনের অনেক যাত্রী ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের জেলার। দুর্ঘটনার পর আশুগঞ্জ, ভৈরবসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে তাদের স্বজনদের খোঁজে আসেন।
সরেজমিন দেখা যায়, ট্রেনের কয়েকটি বগি দুমড়ে মুচড়ে একদিকে হেলে পড়েছে। বগির ভেতরে যাত্রীদের আসনও ভেঙে গেছে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হতাহত যাত্রীদের ব্যাগসহ নানা সরঞ্জাম। এখানে ওখানে রক্তের দাগ লেগে আছে। বগির নিচেও অনেক যাত্রী চাপা পড়েন। বেঁচে যাওয়া যাত্রীদের অনেকে আতঙ্কিত হয়ে কাঁদছিলেন।
ক্ষতিগ্রস্ত ট্রেনের যাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়া স্বর্ণা বেগম বলেন, আমি কিশোরগঞ্জ থেকে এগারসিন্ধুর ট্রেনে উঠি। ভৈরব রেলস্টেশনে পৌঁছি দুপুর ২.৪০ মিনিটে। এরপর ট্রেনের ইঞ্জিন ঘুরিয়ে বিকাল ৩.১২ মিনিটে ট্রেনটি ঢাকার উদ্দেশে ছাড়ে। এর তিন মিনিট পর হঠাৎ বিকট শব্দে ঝাঁকুনি দিতে দিতে ট্রেনটি থেমে যায়। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে আমিও সিট থেকে পড়ে যাই। এরপর যাত্রীদের চিৎকার-কান্না শুরু হয়। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি পেছনের কয়েকটি বগি কাত হয়ে পড়ে গেছে। পরে দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে পড়ি।
ট্রেনের আরেক যাত্রী মোশারফ হোসেন বলেন, ভৈরব থেকে ট্রেনটি স্টেশন ছাড়ার পর আউটার সিগনালে গিয়ে লাইন ক্রস করার সময় বিপরীত দিক থেকে আসা কনটেইনার ট্রেনটি হঠাৎ এগারসিন্ধুর ট্রেনের পেছনের দিকে ধাক্কা দেয়। এ সময় কনটেইনার ট্রেনটির গতি ছিল অনেক বেশি এবং এগারসিন্ধুর গতি ছিল কম। ধাক্কা লাগার সঙ্গে সঙ্গে এগারসিন্ধুর ট্রেনের পেছনের চারটি বগি দুমড়ে মুচড়ে চুরমার হয়ে যায়। বগিগুলো উলটে খাদে পড়ে যায়। এ সময় বগির যাত্রীদের অনেকে চাকার নিচে পড়ে হতাহত হন।
ভৈরব উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাদিকুর রহমান সবুজ, থানার ওসি মোহাম্মদ মাকছুদুল আলম, ভৈরব রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ আলিম সিকদারসহ র্যাব, পুলিশ, ফায়ার সর্ভিস, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা উদ্ধার কাজে অংশ নেন ও তদারকি করেন। রাতে ঢাকা থেকে আসে রিলিফ ট্রেন। এদিকে ঘটনাস্থলে বিদ্যুৎ সংযোগ না থাকায় সন্ধ্যার পর উদ্ধার কাজে বেগ পেতে হয়। হাতে ব্যবহৃত লাইট ও মোবাইলের আলোয় উদ্ধারকর্মীদের কাজ করতে দেখা গেছে।
রাত ৮টা পর্যন্ত ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন-কিশোরগঞ্জের মিটামইনের রাসেল (২১), ময়মনসিংহের নান্দাইলের হোসনা বেগম (২৩) ও বাজিতপুরের আসিব উদ্দিন (২৮)।
আহতদের ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ বিভিন্ন ক্লিনিক ও বাজিতপুর জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ভৈরব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকরা জানান, এই হাসপাতালে ৭০ জন আহত যাত্রীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০ জনকে ঢাকাসহ বিভিন্ন হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক আবুল কালাম আজাদ বলেন, খবর পেয়ে আমি দ্রুত ভৈরব চলে আসি। এখানে এসে উদ্ধার কাজ পরিচালনাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করি। দুর্ঘটনা কিভাবে হলো তা জানতে রেলস্টেশনের কাউকে খুঁজে পাইনি। এমনকি ট্রেনের দুই চালককেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সাদিকুর রহমান জানান, রেলস্টেশনের কন্ট্রোলরুমের ভুলের কারণেই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে বলে জানতে পেরেছি। কিশোরগঞ্জ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ রাসেল শেখ ক বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। খবর পেয়ে আমি দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ তদারকিসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করি। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
ঢাকা-চট্টগ্রাম-সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ: ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে অনেক ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় হয়। বিভিন্ন স্টেশনে নানা গন্তব্যের যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। অনেকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর বাড়ি ফিরে গেছেন। কেউ কেউ বিকল্প পথে গন্তব্যে যান। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের স্টেশন মাস্টার আফছার উদ্দিন জানান, উদ্ধার কাজের জন্য রিলিফ ট্রেন পাঠানো হয়েছে। উদ্ধার কাজ শেষ হলে ট্রেন চলাচল শুরু হবে। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক নাজমুল ইসলাম বলেন, ঘটনার পর আখাউড়া জংশন থেকে টঙ্গী জংশন পর্যন্ত রেললাইনে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে দুদিকে সুবর্ণ এক্সপ্রেস, মহানগর প্রভাতী, মহানগর গোধূলী, কালনী এক্সপ্রেস, চট্টলা এক্সপ্রেস, সোনারবাংলা ট্রেন আটকে পড়েছে।