স্টাফ রিপোর্টার: নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনসহ পুরো নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার চান বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। তাদের মতে, মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে স্বাধীন, শক্তিশালী, কার্যকর এবং অর্থবহ নির্বাচন কমিশন গঠনের বিকল্প নেই। পাশাপাশি নির্বাচনী ব্যবস্থায় যে গলদ রয়েছে, তাও দূর করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন নির্বাচনী ব্যবস্থার আমূল সংস্কার। সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী কমিশন গঠনে দ্রুত একটি স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়ারও দাবি জানিয়েছেন নেতারা। তাদের মতে, অবাধ এবং সুষ্ঠু ভোট নিশ্চিত করতে চাইলে এ ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ নেই।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছর ১৫ ফেব্রুয়ারি। আইন অনুযায়ী এর আগেই রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া শেষ করবেন। তবে কোন পদ্ধতিতে নতুন কমিশন গঠিত হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। সংবিধানে নির্বাচন কমিশন নিয়োগের জন্য একটি আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। তবে বর্তমান সরকারের মেয়াদে দুটি কমিশনই গঠন হয়েছে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। আগামী দিনেও একই পথে হাঁটতে পারেন ক্ষমতাসীনরা। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে কমিশন গঠনে কোন পথ অবলম্বন করা হবে, তা এখনো খোলাসা করা না হলেও বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ইতোমধ্যেই নির্দলীয়-নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে এই কমিশন গঠনের দাবি তুলেছে। সার্চ কমিটির মাধ্যমে না করে সব দলের সঙ্গে প্রকাশ্যে সংলাপে বসে, সবার মতামতের ভিত্তিতে নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন তারা। তবে এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বৃহস্পতিবার বলেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য হাতে আরও সময় আছে। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই। সময়মতো এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হবে।
বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা অবশ্য আগের দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য গঠিত সার্চ কমিটিকে সরকারের এক ধরনের ‘তামাশা’ বলে দাবি করেন। তাদের মতে, সংবিধানেই বলা হয়েছে কমিশন গঠনে আলাদা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতাহারেও স্বাধীন এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কিন্তু রহস্যজনক কারণে আজও এ বিষয়ে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়নি শাসক দলটি।
অবশ্য সবার মতামতের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন করা না হলে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বৃহস্পতিবার বলেন, আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোট কীভাবে হয়, তা দেশবাসীর কাছে আর অজানা না। আমরা আর আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন দেখতে চাই না। তিনি আরও বলেন, আমরা চাই একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন। এ লক্ষ্যে সব বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের পরামর্শের ভিত্তিতেই গঠন করতে হবে নির্বাচন কমিশন। কারণ নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ না হলে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়। বিএনপি মহাসচিব বলেন, দলীয় কমিশনের অধীনে নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হয়, তার বড় প্রমাণ বর্তমান নির্বাচন কমিশন। সবার মতামত উপেক্ষা করে সরকার একতরফাভাবে আজ্ঞাবহ কমিশন গঠন করতে চাইলে তা জনগণ মেনে নেবে না। সবাইকে সঙ্গে নিয়েই এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের এমপি নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বতন্ত্র আইন প্রণয়নের দাবি জানান। তিনি বলেন, এই আইন করার আগে রাজনৈতিক দলগুলোসহ সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং সু?শীলসমাজের প্রতি?নি?ধিদের মতামত নিতে হবে। এরপর বিতর্কিত নন এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য-এমন ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন গঠন করতে হবে। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, আমাদের আগামী দিনের লক্ষ্য হওয়া উচিত ভোট অবাধ ও সুষ্ঠু করা। মানষ যাতে ভোট দিতে পারে, তা নিশ্চিত করা। গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে এটি খুবই জরুরি।
প্রখ্যাত আইনজীবী, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, নির্দলীয়-নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। যারা সাহস এবং সততার সঙ্গে প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত নির্বাচন উপহার দেবে। আগের রাতে ভোটের বাক্স ভরাট করার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসবে-এমন নির্বাচন কমিশন চাই। কালোটাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের জন্য নির্বাচনি ব্যবস্থারও আমূল সংস্কার চাই।
তিনি আরও বলেন, কমিশনের জন্য আইন প্রণয়নের কথা সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা আছে। বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো সরকারই এ কাজটি করেনি। বরং তারা নিজেদের সুবিধামতো পছন্দের লোক বসিয়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছে।
বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এমপি বলেন, নির্বাচনি ব্যবস্থার ভেতরে যে কালো বিড়াল ঘাপটি মেরে আছে, তাকে তাড়াতে হবে। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইনি কাঠামো তৈরি। আইনগতভাবেই এই কমিশনের স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার থাকবে। আর্থিক স্বাধীনতা থাকবে। জনবল নিয়োগের স্বাধীনতা থাকবে। তাহলে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত হবে, অন্যথায় হবে না।
এবারের কমিশন গঠন গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বড় ধরনের ‘অগ্নিপরীক্ষা’ দাবি করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু বলেন, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এবারের নির্বাচন কমিশন গঠন একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং বড় ধরনের অগ্নিপরীক্ষা। এই পরীক্ষায় সরকারসহ সবাইকে পাশ করতে হবেই।
তিনি আরও বলেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে বিতর্কমুক্ত ব্যক্তিদের দিয়ে কমিশন গঠন করা হবে এই অগ্নিপরীক্ষায় পাশ করার প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় ধাপটি হবে-সরকারকে যেমন এ বিষয়ে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে হবে, তেমনই বিরোধী দলগুলোকে বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে মাঠ গরমের চেষ্টা করলে হবে না। তাদেরও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কমিশন গঠনে সহায়তার হাত বাড়াতে হবে।
জাতীয় পার্টি-জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বলেন, আমরা চাই সবার সঙ্গে আলোচনা করে, সবার মতামত নিয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কমিশন গঠন করা হোক।
নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার দাবি করে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এ প্রসঙ্গে বলেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য লোকদের দিয়ে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। একই সঙ্গে কমিশনকে ঢেলে সাজাতেও হবে। নির্বাচনি ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করতে হবে। কালোটাকা, পেশিশক্তির প্রভাব এবং সাম্প্রদায়িক উসকানিমুক্ত নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রশাসনের সহায়তায় একতরফা কিংবা আগের রাতে ভোট করার কারসাজি বন্ধ করতে হবে। অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সংখ্যানুপাতিক হারে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব আইন প্রণয়ন করতে হবে।
সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রপতি সব সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এবং কমিশনার (ইসি) নিয়োগ দিলেও ২০১২ ও ২০১৭ সালে সর্বশেষ দুটি কমিশন গঠিত হয় সার্চ কমিটির মাধ্যমে। ২০১২ সালের ২৪ জানুয়ারি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে নামের সুপারিশ তৈরি করতে চার সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। প্রধান বিচারপতি মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারককে সভাপতি করে গঠিত এ কমিটিতে সদস্য হন হাইকোর্ট বিভাগের একজন বিচারক, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশন চেয়ারম্যান।
২০১৭ সালেও ইসি নিয়োগে একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ছয় সদস্যের সার্চ কমিটির সুপারিশকৃত নামের তালিকা থেকে বর্তমান কমিশনারদের নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। এবারই প্রথমবারের মতো একজন নারী এ কমিশনের সদস্য হিসাবে স্থান পেয়েছেন। এই নির্বাচন কমিশন নিয়ে রাজনীতিতে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে এবং এই কমিশনের আমলে অনুষ্ঠিত প্রায় সবকটি নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি বর্তমান কমিশনের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ নানা অভিযোগ তুলে অপসারণের দাবি তুলেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে বর্তমান কমিশনের দক্ষতা ও যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, কোন পদ্ধতিতে কমিশন গঠিত হবে, তা নিয়ে অতীতের মতো এখনো রাজনৈতিক মতভেদ রয়েছে। তাই এবারও অতীতের মতো রাজনৈতিক সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার এবং বিরোধী দল-উভয়পক্ষকেই সমানভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সবার আগে আইন প্রণয়নের কাজেই হাত দিতে হবে।