স্টাফ রিপোর্টার: বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়া এলাকায় পাহাড়ি সশস্ত্র দুই গ্রুপ ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে ওই সংঘর্ষের পর শুক্রবার দুপুরে খামতাংপাড়া থেকে ৮ জনের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। পুলিশ জানায়, ঘটনাস্থল থেকে দুটি বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে। তবে নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি তারা। এদিকে গোলাগুলির ঘটনার পর আতঙ্কে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার সীমান্তবর্তী খামতাংপাড়া এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, রোয়াংছড়ি উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে খামতাংপাড়া এলাকায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান স্থানীয়রা। শুক্রবার সকালে স্থানীয় লোকজন কাজে যাওয়ার সময় ৮টি মরদেহ দেখতে পেয়ে পুলিশকে জানালে রোয়াংছড়ি থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে মরদেহগুলো উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে। নিহতদের মধ্যে সাত জনের নাম জানা গেছে বলে স্থানীয়রা দাবি করলেও পুলিশ এখনো নিহতদের পরিচয় নিশ্চিত হতে পারেনি।
রোয়াংছড়ি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আবদুল মান্নান আটজন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত করে জানান, ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) সদস্যদের মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে বলে তারা ধারণা করছেন। নিহত ব্যক্তিদের পরনে বিশেষ এক ধরনের পোশাক রয়েছে। তবে এখনো তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ বান্দরবান সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়েছে।
মরদেহে থাকা ইউনিফর্ম দেখে পুলিশ এবং স্থানীয়রা ধারণা করছেন, মরদেহগুলো পাহাড়ে সদ্য গজিয়ে ওঠা কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সদস্যদের। এ ব্যাপারে পুলিশ সুপার তারিকুল ইসলাম বলেন, ‘পাহাড়ি সশস্ত্র দুই গ্রুপের গোলাগুলির ঘটনায় ৮ জন নিহত হয়েছে। গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করে প্রাথমিক সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য বান্দরবান সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে গোলাগুলির ঘটনার পর আতঙ্কে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার সীমান্তবর্তী খামতাংপাড়া এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়েছে। ওই এলাকার ২০টির মতো পরিবার আশ্রয় নিয়েছে রুমা উপজেলা সদরে। নারী-শিশুসহ ১৮৩ জন এসে আশ্রয় নিয়েছেন রোয়াংছড়ি উপজেলা সদরে। রোয়াংছড়ি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে অনেকে। আশ্রিতদের খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
এ ব্যাপারে খামতাং পাড়ার কারবারি মানিক খিয়াং বলেন, ‘গতকাল (বৃহস্পতিবার) দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে গোলাগুলি হয়েছে বলে শুনেছি। গতকাল পুলিশ এসে আটটি লাশ উদ্ধার করে নিয়ে গেছে। ভয়ে এলাকার ৭০টির মতো পরিবার এখন বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে।’ রুমা উপজেলার পাইন্দু ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উ হ্লাং মং মার্মা বলেন, ‘এরই মধ্যে রুমা উপজেলা সদরের বম কমিউনিটি সেন্টারে ৪০ জন নারী ও শিশু এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের নামের তালিকা করা হচ্ছে। আরও আসছে বলে শুনেছি।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বান্দরবান সদর জোনের কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ফাহিম সাংবাদিকদের বলেন, ‘খামতাংপাড়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যক্রম বেড়ে চলেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা কেএনএফের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও উৎপাতে থাকতে না পেরে আশ্রয় নেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর রোয়াংছড়ি ক্যাম্পে চলে এসেছেন। বেসামরিক প্রশাসনের সহযোগিতায় সেনাবাহিনী তাদের থাকা এবং খাবারের ব্যবস্থা করেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের এখানে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হবে। নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বেসামরিক প্রশাসনের সহায়তায় তাদের সেখানে স্থানান্তর করা হবে।’
এর আগে গত ১২ মার্চ রোয়াংছড়ির দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কেএনএর সশস্ত্র সন্ত্রাসী দলের অতর্কিত গুলিবর্ষণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন নিহত হন। ওই ঘটনায় আহত হন দুজন সেনাসদস্য। ২২ মার্চ সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন রোয়াংছড়ি উপজেলার খামতাংপাড়ার কারবারী। পাহাড়ে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে প্রায়ই গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে।
অন্যদিকে গোলাগুলির ওই ঘটনার পর ইউপিডিএফ’র দিতে অভিযোগ উঠলেও এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক উবা মং মারমা স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাসী। আমরা এ সংঘর্ষে জড়িত ছিলাম না’।
প্রসঙ্গত সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করলেও সংগঠনটি তাদের ফেসবুক পাতায় দাবি করেছে, তারা বাংলাদেশের কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন নয়। একই সঙ্গে তারা জানিয়েছে, তাদের ভাষায়, ‘সুবিধা বঞ্চিত কুকি-চিন জনগোষ্ঠীর জন্যে স্বশাসিত বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতাসহ একটি ছোট রাজ্য চাইলেও তারা কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়নি।’
গত বছরের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে ফেসবুকে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি এবং বান্দরবানের রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদম উপজেলাগুলোর সমন্বয়ে পৃথক রাজ্যের দাবি করে তারা। তখন সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে নাথান বমের নাম ঘোষণা করে তারা। মি. বম এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং বান্দরবানের রুমা উপজেলায় তার বাড়ি বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির তথ্যে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য যে সংগঠনটি সবচেয়ে বেশি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটির নাম ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ। নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো কোনো সূত্রের ভাষ্য, সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিডিএফ হয়তো নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে নতুবা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। ওদিকে, ইউপিডিএফ-এর বক্তব্য তারা রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে।
বিবিসি জানায়, পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, রোয়াংছড়ির ঘটনায় ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) অংশের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে। পার্বত্য শান্তিচুক্তির বিরোধিতার মাধ্যমে ১৯৯৮ সালের ২৬ জুন ঢাকায় এক কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউপিডিএফ-এর জন্ম হয়।
তবে পুলিশ ও স্থানীয়দের ভাষ্য অনুযায়ী কুকিচিন ন্যাশনাল আর্মি ও ইউপিডিএফ ডেমোক্র্যাটদের মধ্যে সংঘর্ষের জের ধরেই ওই গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে।