বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস কাতারের প্রধানমন্ত্রীর

শিক্ষার্থীদের ‘তিন-শূন্য মানুষ’ হিসেবে প্রস্তুত করার পরামর্শ অধ্যাপক ইউনূসের

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানি। গতকাল বৃহস্পতিবার দোহায় কাতারের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি এ আশ্বাস দেন। বৈঠকে কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে তার একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে মনোনীত করবেন। চলমান সংস্কার ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ আগামী বছরগুলোতে আরো শক্তিশালীভাবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে আস্থা প্রকাশ করেন শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুল রহমান বিন জসিম আল থানি। তিনি অধ্যাপক ইউনূসকে বলেন, আমরা আপনার অব্যাহত নেতৃত্বের ওপর আস্থা রাখি। প্রধান উপদেষ্টা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কূটনৈতিক, আর্থিক ও বিনিয়োগ খাতে কাতারের পূর্ণ সহযোগিতা কামনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষ, বিশেষ করে তরুণ জনগোষ্ঠীর জন্য নতুন সুযোগ এবং একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করা। অধ্যাপক ইউনূস কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আমাদের তরুণদের স্বপ্নের দেশ গড়তে আপনাদের সহায়তা প্রয়োজন। শেখ মোহাম্মদ প্রধান উপদেষ্টাকে বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করার জন্য কাতারে একটি কারিগরি দল পাঠানোর আহ্বান জানান। বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়েও আলোচনা হয়। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা জনগণ যাতে মর্যাদার সঙ্গে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে, তা নিশ্চিত করার জন্য সম্ভাব্য সকল সহায়তার আহ্বান জানান। আর্থনা শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সংলাপ আয়োজনে সহায়তা করার জন্য কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান অধ্যাপক ইউনূস।
১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী। শেখ মোহাম্মদ রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সমর্থন জোরালো করার আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি এবং সমস্যার টেকসই সমাধানে কাতারের অব্যাহত সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। দুই নেতা গাজার পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা করেন। অধ্যাপক ইউনূস দুঃখ প্রকাশ করেন যে, গাজার দুর্দশার বিষয়ে বিশ্বের বেশির ভাগ অংশ এখনো নীরব। কাতারের প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। অনেক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও গাজা সংকট কভার করার জন্য কাতারভিত্তিক সম্প্রচারমাধ্যম আলজাজিরাকে ধন্যবাদ জানান বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা। অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা প্রদানে কাতারের সহায়তা কামনা করেন। তিনি কাতারের প্রধানমন্ত্রীকে সুবিধাজনক সময়ে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান। শেখ মোহাম্মদ এই অনুরোধ সানন্দে গ্রহণ করেন। বৈঠকে অন্যদের মধ্যে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান এবং এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন। তরুণ প্রজন্মকে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজন্ম অভিহিত করে প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদেরকে কল্পনা করতে, বড় স্বপ্ন দেখতে এবং নিজেদেরকে ‘তিন-শূন্য মানুষ’ হিসেবে গড়ে তুলতে উৎসাহিত করেছেন। তিনি গতকাল দোহায় কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’ শিরোনামে এক অনুপ্রেরণামূলক বক্তৃতা প্রদান করেন। প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আমি যখন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাই, তখন খুবই স্বস্তি বোধ করি। আমি নিজেকে তরতাজা অনুভব করি। তোমরা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রজন্ম। আমি আন্তরিকভাবে তা বিশ্বাস করি। তোমরাই সুপারম্যান আর সুপারওম্যান। অধ্যাপক ইউনূস শিক্ষার্থীদের বলেন, এমন কিছু করো না যা ধনসম্পদের কেন্দ্রীকরণে অবদান রাখে। বরং কল্পনা করো এবং স্বপ্ন দেখো এমন একটি নতুন পৃথিবী গড়ার, যেখানে আত্মবিধ্বংসী পদ্ধতির কোনো স্থান নেই। অনুষ্ঠানের শুরুতে অধ্যাপক ইউনূসকে বিশ্ব মানবতার কল্যাণে অসামান্য অবদানের জন্য সম্মানসূচক অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। নোবেল বিজয়ী ও ‘ব্যাংকার টু দ্য পুওর’ বইয়ের লেখক অধ্যাপক ইউনূস তার বক্তব্যে একটি উদীয়মান নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরেন, যা মানবজাতি এবং পৃথিবীকে রক্ষা করতে পারে। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, গন্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কিন্তু তোমাকে অবশ্যই স্বপ্ন দেখতে হবে, কল্পনা করতে হবে। তিনি আরও বলেন, যদি তুমি কল্পনা করো, সেটা তোমাকে সাহায্য করবে। কল্পনাকে অবহেলা করো না। অধ্যাপক ইউনূস তার ‘তিন শূন্য’ ভাবনার কথা তুলে ধরেন- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নিট কার্বন নিঃসারণ। তিনি ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে এই প্রজন্ম আত্মবিধ্বংসী সভ্যতা থেকে বেরিয়ে এসে পরিবেশের রক্ষক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কাতারের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, আপনারা এ সুযোগ নিতে পারেন। বুধবার রাতে কাতার ও বাংলাদেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বিনিয়োগ সম্ভাবনা নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ এখন আবার ব্যবসায় ফিরেছে এবং তা বড় পরিসরে। আমরা আপনাদের অংশীদারত্ব চাই। প্রধান উপদেষ্টা জানান, অন্তর্বর্তী সরকার দেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছে এবং একটি দুর্নীতিমুক্ত নতুন বাংলাদেশ গঠনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি নরওয়েজিয়ান টেলিকম অপারেটর টেলেনরকে বাংলাদেশে কীভাবে একটি টেলিফোন কোম্পানি গঠন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল সে প্রেরণাদায়ক গল্পটি তুলে ধরেন, যা পরে টেলেনরের সবচেয়ে লাভজনক উদ্যোগে পরিণত হয়। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ফোরাম, কাতারের সভাপতি আজাদ আশরাফ স্বাগত বক্তব্য দেন। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী সম্ভাব্য কাতারি বিনিয়োগকারী ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের সামনে বাংলাদেশে বিনিয়োগের সুযোগ এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেওয়া সংস্কারমূলক পদক্ষেপ নিয়ে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে ৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অনাদায়ী ঋণ ছিল, যা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৬০০ মিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে কাতার এনার্জির কাছে ২৫৪ মিলিয়ন ডলারের বকেয়া ছিল, যা বুধবারের মধ্যে শূন্যে নেমে এসেছে। তিনি জ্বালানি নিরাপত্তা এবং উন্নত অবকাঠামো নিয়ে সরকারের পরিকল্পনা তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে কাতারের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি সালেহ মাজেদ আল খালাফি, নেক্সট স্মার্ট সলিউশনসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা আলি বেন ফার্জসহ অন্যরা বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন। কাতারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নজরুল ইসলাম সমাপনী বক্তব্য প্রদান করেন।