সেপ্টেম্বরজুড়ে ছুটি থাকতে পারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে : জেএসসি বাতিলের প্রস্তাবে বিভিন্ন বোর্ডের মিশ্র পরামর্শ
স্টাফ রিপোর্টার: প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) এবং ইবতেদায়ি শিক্ষা সমাপনী (ইইসি) পরীক্ষা এবার হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এই পরীক্ষা বাতিল করেছে। তবে মহামারী পরিস্থিতি উন্নত হলে স্কুল ও মাদরাসা খোলা সম্ভব হলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা নেয়া হবে। গতকাল মঙ্গলবার এই পরীক্ষার পরিমার্জিত পাঠ-পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে পিইসি-ইইসি বাতিল করায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন অভিভাবকরা। পাশাপাশি তারা এই দুটি পরীক্ষা আজীবনের জন্য বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।
অন্যদিকে জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা সংক্রান্ত একটি ফাইলও প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্র। ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের উপস্থিতিতে চার সচিবের বৈঠকে পিইসির পাশাপাশি জেএসসি (জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট) এবং জেডিসি (জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা বাতিলের প্রস্তাবও প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শীর্ষপর্যায়ের সূত্র জানিয়েছে, এবারের জন্য জেএসডি-জেডিসি বাতিলের প্রস্তাব পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিলো। সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড থেকে মিশ্র পরামর্শ এসেছে। কেউ কেউ বাতিল না করার পক্ষে পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে করোনা প্রাদুর্ভাব পরিস্থিতি পরীক্ষা গ্রহণের অনুকূলে নয়। বোর্ড চেয়ারম্যানদের এ ধরনের পরামর্শের কারণে ফাইল তৈরির প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে।
পিইসি বাতিলের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন। গতকাল মঙ্গলবার এক তাৎক্ষণিক ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে আমরা শিক্ষার্থীদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে চাই না। এজন্য এ বছর পিইসি-ইইসি পরীক্ষা বাতিল করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি সারসংক্ষেপ পাঠাই। তাতে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি দিয়েছেন। এ বছর পরীক্ষা নেয়া না হলেও স্কুল খোলা সম্ভব হলে শিক্ষার্থীদের ক্লাস মূল্যায়নের মাধ্যমে ষষ্ঠ শ্রেণিতে উন্নীত করা হবে। অন্যান্য ক্লাসের বার্ষিক পরীক্ষাগুলোও নেয়া হবে। এ প্রসঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আকরাম-আল-হোসেন বলেন, এ বছর কেন্দ্রীয়ভাবে পিইসি-ইইসি পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব না হওয়ায় পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি প্রদান করা হবে না। তবে নিয়মিত কার্যক্রম হিসেবে উপবৃত্তি প্রদান করা হবে। আগামী বছর পরীক্ষা আয়োজন করা সম্ভব হলে আবারও বৃত্তি কার্যক্রম শুরু করা হবে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সূত্র জানিয়েছে, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার পাঠ পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে মঙ্গলবার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এটি তৈরি করেছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ)। সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. শাহ আলম জানান, বৃহস্পতিবার নাগাদ অনুমোদিত ‘পরিমার্জিত বার্ষিক পাঠ পরিকল্পনা-২০২০’ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। এরপর তা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মাধ্যমে স্কুলে স্কুলে শিক্ষকদের কাছে পাঠানো হবে। তারা এটা দেখে পাঠদানের প্রস্তুতি নেবেন।
জানা গেছে, পরিমার্জিত পাঠদান পরিকল্পনায় অক্টোবর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে পাঠ্যবই ও সিলেবাসের কতটুকু পড়ানো হবে, আর নভেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে কতটুকু পড়ানো হবে, সেটা প্রস্তাব করা হয়েছে। অক্টোবরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলবে ক্লাস। এতে ৫৭ কর্মদিবস পাওয়া যাবে। আর নভেম্বরে খুললে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাওয়া যাবে ৪০ কর্মদিবস। এই সময়ে কেবল সাপ্তাহিক, ধর্মীয় এবং জাতীয় দিবসের ছুটি থাকবে। শীতকালীন ১০ দিনসহ অন্য ছুটি বাতিল করা হয়েছে। পাঠদান শেষে ২ দিন থাকবে পরীক্ষার প্রস্তুতির ছুটি। এরপর নেয়া হবে (ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে) বার্ষিক পরীক্ষা।
পরিমার্জিত পাঠ পরিকল্পনা তৈরিতে ৫টি নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। তা হচ্ছে- আগের শ্রেণিতে যে শিখন ফল শিক্ষার্থীরা অর্জন করেছে সে ধরনের পাঠ বাতিল; পরের শ্রেণির লেখাপড়ার জন্য যে পাঠ আগে শেখা দরকার, তা থাকছে; স্পাইরাল কারিকুলামের (সর্পিল বা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত) পাঠ থাকছে; জাতীয় ও সামাজিকসহ প্রয়োজনে যে পাঠ অপরিহার্য তা থাকছে; খোলা পরবর্তী কর্মদিবস বিবেচনায় বয়স অনুযায়ী যতটুকু চাপ সহ্য করতে পারবে ততুটুক পাঠ রাখা হয়েছে। আর পাঠ পরিকল্পনায় নেয়া হয়েছে তিন কৌশল। এক. জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) শিক্ষক গাইডের নির্দেশনা; দুই. সারা দেশের শ্রেণিশিক্ষকের মতামত (১৪ জনের মত নেয়া হয়) এবং তিন. স্বাভাবিক ছুটি বহাল (সাপ্তাহিক), যাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অভ্যাসের ওপর চাপ না আসে। মোট তিনটি পরিকল্পনা তৈরি করা হলেও বৈঠকে পরিকল্পনা-বি এবং পরিকল্পনা-সি অনুমোদন পেয়েছে। সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সম্ভাবনা না থাকায় পরিকল্পনা-এ উপস্থাপিত হয়নি।
সূত্র জানায়, এ নীতি অনুসরণ করতে শিখন ফলের ওপর চাপ তুলনামূলক কম পড়লেও পাঠ্যবই বা সিলেবাস বেশ কমেছে। অক্টোবরে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হলে সিলেবাসের ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বাদ যাবে। এতে শিক্ষার্থীরা শ্রেণি ও বয়স অনুযায়ী ৯০ শতাংশ শিখতে পারবে। বাকি ১০ শতাংশ ঘাটতি পরবর্তী শ্রেণিতে পূরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আর নভেম্বরে শুরু করা গেলে সিলেবাসের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাদ যাবে। এতে শিক্ষার্থীরা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত শিখনফল অর্জন করবে। করোনা পরিস্থিতি শুরুর আগে ১৭ মার্চ পর্যন্ত ইতোমধ্যে পাঠ্যক্রম বা সিলেবাসের ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ পড়ানো হয়েছে। ফলে আগের পঠিত অংশ বাদ দিলে আর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ পাঠ বা সিলেবাস বাদ যাচ্ছে। অর্থাৎ, এই প্রস্তাব অনুযায়ী, করোনার কারণে শিক্ষার্থীদের শেখার ঘাটতি থাকছে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ আর সিলেবাস কমছে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি: বর্তমানে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় সাধারণ ছুটি চলছে। ৩১ আগস্ট এই ছুটি শেষ হওয়ার কথা আছে। তবে ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে গোটা সেপ্টেম্বর মাসই ছুটি থাকতে পারে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। দুই মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলাপে এই আভাস পাওয়া গেছে। দু-একদিনের মধ্যে এ সম্পর্কিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অবশ্য আসবে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন জানান, করোনা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। মনে হচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া সম্ভব হবে না। তবে দুই মন্ত্রণালয় আলোচনা শেষে দু-একদিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি সংক্রান্ত নির্দেশনা আমরা এখনও পাইনি। তবে দু-একদিনের মধ্যে এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত হবে।
জেএসসিও বাতিলের প্রস্তাব এবং নিম্নমাধ্যমিক স্তর : এদিকে করোনা পরিস্থিতির কারণে জেএসসি-জেডিসি বাতিলের নীতিগত সিদ্ধান্তও আছে। সে অনুযায়ী একটি ফাইল প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই ফাইলে কী প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে, সে বিষয়ে কেউই মুখ খুলছেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা শিক্ষা বোর্ডগুলোর আয়ের বড় একটি উৎস। এই পরীক্ষায় প্রায় ২৫ লাখ পরীক্ষার্থী থাকে। এ কারণে বোর্ডগুলো করোনার বাস্তবতা আমলে না নিয়ে পরীক্ষা আয়োজনের পক্ষে মত দিয়েছে। এক্ষেত্রে জেএসসি-জেডিসি সনদের প্রয়োজনীয়তার যুক্তি দিচ্ছেন। এ কারণে প্রস্তাব পাঠাতে বিলম্ব হয়েছে। পাশাপাশি প্রস্তাব নিয়ে মন্ত্রণালয় খুবই গোপনীয়তা বজায় রাখছে।
অন্যদিকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক পরীক্ষার ‘কারিকুলাম ম্যাপিং’ ও ‘পাঠ পুনর্বিন্যাস পরিকল্পনা’ চূড়ান্ত করার কাজ চালাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বৃহস্পতিবারের মধ্যে এটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বলে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা জানান।
সূত্র জানিয়েছে, এনসিটিবি কেবল ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির জন্য পৃথক তিনটি পরিকল্পনা তৈরি করেছে। নবম শ্রেণির জন্য কোনো পাঠ সংকোচনের নীতি গ্রহণ করা হবে না। দুই বছরের জন্য এই স্তরে পাঠ্যবই তৈরি করা হয়। নবম শ্রেণিতে যা পড়ানো বাকি থাকবে, সেটা দশম শ্রেণিতে পড়ানো হবে। এই স্তরেও ডিসেম্বরের মধ্যে বার্ষিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে মন্ত্রণালয়ে।
এনসিটিবি সূত্র জানায়, নিম্নমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের করোনা-পরবর্তী শ্রেণি কার্যক্রমের জন্য তিনটি বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর সম্ভাব্য কর্মদিবস ধরে তৈরি করা হয়েছে এ প্রস্তাব। সে অনুযায়ী সর্বনিম্ন ৩০ দিন শ্রেণি কার্যক্রম চালানো সম্ভব হলে পাঠ্যবইয়ের কতটুকু অংশ পড়ানো হবে, তা চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়া ৫০ এবং ৭৩ কর্মদিবস সময় পেলে কতটুকু পড়ানো যাবে, তা-ও চিহ্নিত করা হয়েছে।