পাচারের অর্থ ফেরত পেতে তৎপরতা নেই

 

স্টাফ রিপোর্টার: অর্থ পাচার বিষয়ে ২০১০ সালের মামলা ঝুলে রয়েছে এখনও। শুনানির জন্য বারবার সময় বাড়ানো এবং এক শুনানি থেকে পরের শুনানির মধ্যে অনেক লম্বা সময় দেওয়া হচ্ছে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে তথ্য চেয়ে আশানুরূপ সাড়া মিলছে না। প্রাথমিক প্রমাণের ভিত্তিতে ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত শুধু দুদক ৩৪ পাচারকারীর তথ্য চেয়ে অনুরোধ করে একটিও পায়নি। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য সহায়তা বিষয়ে সাতটি দেশের সঙ্গে চুক্তির অনুরোধ (এমএলএ) দীর্ঘদিন ধরে ঝুলছে। এভাবে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে নানা সংকট। সংশ্নিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর মাধ্যমে এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করছে পাচার করা অর্থ ফেরত আনা-সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স।

গতকাল মঙ্গলবার কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের বৈঠকে এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিনের সভাপতিত্বে সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, কাস্টমস গোয়েন্দা এবং বিএসইসির প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

বৈঠকে জানানো হয়, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাজ করা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হিসেবে বিএফআইইউ প্রাথমিক গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান করে। তবে এসব তথ্য আদালত বা কোথাও প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে দেশের ভেতরে তদন্ত শেষে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্সের (এমএলএ) আওতায় তথ্য চাইতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের সঙ্গে এমএলএ রয়েছে শুধু ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার। পাচার অর্থ উদ্ধারে প্রয়োজনীয় তথ্য, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য বেশ আগে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে চুক্তির অনুরোধ জানিয়েও সাড়া পায়নি দুদক। এই ৭ দেশের পাশাপাশি এখন অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও হংকং-চীনের সঙ্গেও চুক্তির পরামর্শ দিয়েছে বিএফআইইউ। দ্রুত এসব দেশের সঙ্গে চুক্তি করার জন্য স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের তথ্য দিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এলসির তথ্য পর্যালোচনাও বাণিজ্যের আড়ালে বিপুল অর্থ পাচারের তথ্য মিলেছে। তবে পাচার অর্থ উদ্ধার হয়েছে সামান্য। এ পর্যন্ত বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর ২১ কোটি টাকা এবং ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের পাচার করা প্রায় ২১ কোটি টাকা দেশে এসেছে। এর বাইরে কয়েকটি দেশে বাংলাদেশ থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে পাচার করা হয়েছে এমন অভিযোগে কয়েকজনের অর্থ অবরুদ্ধ রয়েছে। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত এবং অবরুদ্ধ থাকা এসব আবেদন সবই পাঠানো হয় ২০১৮ সালের আগে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ৫৯ হাজার ৩৪১ ব্রিটিশ পাউন্ড যুক্তরাজ্যের স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেনের ৮ লাখ ৮ হাজার ৫৩৮ ব্রিটিশ পাউন্ড, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের এক কোটি ৬০ লাখ হংকং ডলার এবং তারেক রহমানের বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের ৪ লাখ ১৮ হাজার ৮৫৩ ব্রিটিশ পাউন্ড, বিএনপির সাবেক এমপি মোসাদ্দেক হোসেন ফালুর দুবাইয়ে ৪৯ লাখ ৪০ হাজার টাকার শেয়ার, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবজাল হোসেনের ৯ লাখ ২৯ হাজার ৬৭০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত এবং তার স্ত্রী রুবিনা খানমের ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৫২০ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত অবরুদ্ধ আছে।

এছাড়া প্রয়াত বিএনপি নেতা সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের যুক্তরাজ্যে, এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হকের দুবাইয়ে ১৬৫ কোটি টাকা, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের এক কোটি ৬৮ লাখ টাকা সিঙ্গাপুরে এবং বিএনপির মোসাদ্দেক আলীর ১৪৯ কোটি টাকা পাচারের তথ্য চেয়ে দুবাইয়ের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে আইনি সহায়তা পেতে চিঠি দিয়েছে দুদক। ক্যাসিনোকা- ফাঁসের পর বহিস্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পাচারের বিষয়ে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের কাছে আইনি সহায়তা চেয়েছে দুদক। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রে জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের পরিচালক সেলিম প্রধানের ১২ কোটি টাকা, অস্ট্রেলিয়াতে বিসিবির সাবেক পরিচালক লোকমান হোসেন ভূইয়ার ৪ কোটি ৩৪ লাখ টাকা, যুবলীগ নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের ৩ কোটি টাকা ও মমিনুল হক সাঈদের ৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা পাচারের বিষয়ে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার কাছে আইনি সহায়তা চাওয়া হয়েছে। এসব ব্যক্তিসহ অনেকের তথ্য চেয়েও পাচ্ছে না দুদক।

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এ বিষয়ে মামলার জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দায়িত্বপ্রাপ্ত। এসব সংস্থা এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মামলা করেছে। বৈঠকের একটি সূত্র জানায়, দুদক ২০১৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩৪টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে। তবে আজ পর্যন্ত একটিরও জবাব পাওয়া যায়নি। শুধু তিনটি দেশ থেকে দুদকের আবেদন পদ্ধতির ত্রুটিসহ তুলে ধরে ফেরত পাঠিয়েছে। বাকি ৩১টি আবেদনের বিষয়ে কোনো জবাবই মেলেনি। ৩৪টি অনুরোধের বিষয়ে তথ্য দেওয়ার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসব দেশে তাগাদা পত্র দেওয়া হবে।

বৈঠকে জানানো হয়, তথ্য চেয়ে না পেলেও বিদেশে বাংলাদেশি অনেক দূতাবাস কোনো তৎপরতা দেখায় না। তারা এ বিষয়ে নিষ্ফ্ক্রিয় থাকে। অথচ যক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডার মতো প্রভাবশালী দেশ থেকে কোনো আবেদন আসার পর দ্রুত সময়ে এসব দেশের দূতাবাস থেকে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে। পরে দফায় দফায় ফলোআপ করে তারা। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ায় কে কোথায় বাড়ি কিনছে- চাইলে বিদেশি মিশনের মাধ্যমে সে তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব। কেননা প্রতিটি দেশে সম্পদ কেনার সময় রেজিস্ট্রেশনের সময় বিস্তারিত তথ্য থাকে। এক্ষেত্রে বিদেশি মিশনগুলোর তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করে কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্স।

বিদেশে পাচার করা সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে ২০১৩ সালে গঠিত টাস্কফোর্সের সপ্তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে গতকাল। এর আগে গত জানুয়ারিতে হয় ষষ্ঠ সভা। এর আগে অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি ছিল। তবে এ বছরের জুনে অ্যাটর্নি জেনারেলের নেতৃত্বে কমিটি পুনর্গঠিত হয়েছে।

মানি লন্ডারিং বিষয়ক কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সভা আজ:মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসে অর্থায়ন প্রতিরোধ ও দমন জোরদার বিষয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হবে আজ বুধবার। বিএফআইইউর প্রধান মো. মাসুদ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে আজকের ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে পাচার ঠেকানোর বিভিন্ন উপায় নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। বিশেষ করে ডিজিটাল হুন্ডিতে এমএফএসের ব্যবহার এবং বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের বাংলাদেশে এসে অবৈধভাবে কাজ করার বিষয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া কার্ব মার্কেটে ডলারের অস্থিতিশীল মূল্যমান ঠেকাতে বিএফআইইউর বিভিন্ন পদক্ষেপ বিষয়ে আজকের সভায় আলোচনা হবে। ডিজিটাল হুন্ডি প্রতিরোধে এমএফএস এজেন্টশিপ বাতিলসহ বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হবে।

জানা গেছে, এ বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক লাখ ২১ হাজারের মতো বিদেশি নাগরিক অবস্থান করছে। তাদের মধ্যে চীনা নাগরিক অনেকে অন-অ্যারাইভাল ও বিজনেস ভিসা নিয়ে এসে অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হচ্ছে। নাইজেরিয়া ও সোমালিয়া থেকে শিক্ষার্থী ভিসায় এখানে এসে শিক্ষা কার্যক্রম অসম্পূর্ণ রেখেই তৈরি পোশাক শিল্পের ব্যবসা, বিভিন্ন ক্লাবে ফুটবল খেলা ও অপরাধমূলক কাজে যুক্ত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের সঙ্গে বিয়েসহ নানা প্রতারণা, ফৌজদারি অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যথাযথভাবে রাজস্ব না পাওয়ায় সরকার প্রতিবছর আনুমানিক সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আবার অবৈধ উপায়ে বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে, যা অর্থনীতির জন্য হুমকির।

Comments (0)
Add Comment