স্টাফ রিপোর্টার: মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কুতুবপুর এলাকায় ঢাকাগামী ইমাদ পরিবহণের যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে ২০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে এই দুর্ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে ৯ জনই গোপালগঞ্জের। এ ছাড়া খুলনার চারজন বাকিরা বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা।
হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয়রা জানান, রোববার ভোর ৪টার দিকে খুলনার ফুলতলা থেকে বাসটি ছাড়ে। পরে ভোর ৫টা ৫ মিনিটে খুলনার সোনাডাঙ্গা থেকে ইমাদ পরিবহণের বাসটি যাত্রী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হয়। বাসটির চালক সকাল সাড়ে ৭টার দিকে পদ্মা সেতুর আগে এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারান। বাসটি রেলিং ভেঙে পল্টি খেয়ে খাদে পড়ে যায়। এতে বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়।
নিহত ২০ জনের মধ্যে ১৪ জনের লাশ ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ৬ জনের মধ্যে তিনজনকে আহত অবস্থায় শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নেয়ার পথে মারা যান। আর দুজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন। দুর্ঘটনায় ২০জনের মৃত্যুর খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাসুদ আলম।
এদিকে, দুর্ঘটনায় নিহত ২০ জনের মধ্যে ১৭ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এই ১৭ জনের লাশ পরিবারের কাছে বিকাল ৩টার মধ্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিরা হলেন- গোপালগঞ্জের গোপীনাথপুর এলাকার তৈয়ব আলীর ছেলে হেদায়েত মিয়া, বনগ্রাম এলাকার শামসুল শেখের ছেলে মোস্তাক আহমেদ, সদর উপজেলার নশর আলী শেখের ছেলে সজীব শেখ, পাচুরিয়া এলাকার মাসুদ হোসেনের মেয়ে সুইটি আক্তার, টুঙ্গিপাড়ার কাঞ্চন শেখের ছেলে করিম শেখ, সদর উপজেলার আবু হেনা মোস্তফার মেয়ে আফসানা মিমি ও মুকসুদপুর এলাকার আমজেদ আলীর ছেলে মাসুদ আলী; খুলনার সোনাডাঙা এলাকার
শেখ মোহাম্মদ আলীর ছেলে আবদুল্লাহ আল মামুন, সাউথ মেন্টাল রোড এলাকার চিত্ত রঞ্জন ঘোষের ছেলে চিন্ময় প্রসূন ঘোষ, ডুমুরিয়া এলাকার পরিমল সাদুখার ছেলে মহাদেব কুমার সাদুখা, আমতলা এলাকার শাহজাহান মোল্লার ছেলে আশফাকুর জাহান লিংকন; বাগেরহাট জেলা শহরের শান্তি রঞ্জন মজুমদারের ছেলে অনাদি মজুমদার; ফরিদপুরের হিদাডাঙ্গা এলাকার সৈয়দ মুরাদ আলীর ছেলে মো. ইসমাইল হোসেন; নড়াইলের লোহাগড়া এলাকার বকু শিকদারের ছেলে ফরহাদ শিকদার; ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলী আকবরের ছেলে ও ইমাদ পরিবহণ বাসটির চালক জাহিদ হাসান, চালকের সহকারী মিরাজ এবং পাবনার সুজানগরের গহর আলীর ছেলে ইউসুফ আলী।
আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রয়েছে মিনহাজ বিশ্বাস (২২) ও শেখ আলী আকবরের (৭৫) লাশ। মিনহাজ গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার মানিকদি গ্রামের মিজানুর রহমান বিশ্বাসের ছেলে। আলী আকবরের বাড়ি বাগেরহাটের রামপাল উপজেলায়।
স্থায়ীয় উদ্ধারকর্মীরা জানান, বাসটি ভরা যাত্রী ছিলেন। সড়ক থেকে বাসটি পড়ার সময় ডিগবাজি খায়। এ কারণে এত প্রাণহানি। এক্সপ্রেসওয়েতে এর আগেও বাস, প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস দুর্ঘটনায় পড়েছে। কিন্তু এবারই প্রথম বাস খাদে পড়ে ১৯ জন মারা গেছেন। এক্সপ্রেসওয়েতে চালকরা অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালান যা এখানে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
শিবচর হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু নাঈম মো. মোফাজ্জেল হক বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অতিরিক্ত গতির কারণে বাসটির চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি খাদে পড়ে যায়।
ফরিদপুর ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক শিপলু আহমেদ জানান, মাদারীপুরের শিবচরের কুতুবপুর এলাকায় দুর্ঘটনাকবলিত ইমাদ পরিবহণের যাত্রীবাহী বাসটিতে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী ছিল। এমনকি ইঞ্জিন কাভারটিও যাত্রীতে ভরা ছিল। দুর্ঘটনাকবলিত গাড়িটি ৫৪ আসনবিশিষ্ট একটি বাস ছিল। প্রতিটি আসন ও সামনের ইঞ্জিনের কাভারের যাত্রী মিলিয়ে বাসটিতে কমপক্ষে ৬০ জন ছিলেন। এর মধ্যে যারা সামনের দিকে বসেছিলেন তাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন।
মাদারীপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. মাসুদ আলম বলেন, খুলনা থেকে ঢাকাগামী যাত্রীবাহী ইমাদ পরিবহণের বাসটির সামনের ডান পাশের চাকা এক্সপ্রেসওয়েতে ফেটে যায়। বাসটি তখন রেলিং ভেঙে পাশের খাদে পড়ে যায়। প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, যান্ত্রিক ত্রুটি, অতিরিক্ত গতি ও সামনের ডান পাশের চাকা ফেটে দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। এ ঘটনায় হাইওয়ে পুলিশ তদন্ত করবে। তদন্ত শেষে বাসটির ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স এসব জেনে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা যাবে।
এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা দেখেছি বাসটির সামনের ডান চাকা ফেটে গেছে। সড়কের রেলিং ভেঙে বাসটি উড়ে নিচে সংযোগ সড়কের খাদে পড়ে যায়। এ কারণে বাসটির সামনের অংশ দুমড়েমুচড়ে গেছে।’
এদিকে, দুর্ঘটনার পর স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে উদ্ধারকাজে অংশ নেয়া মাদারীপুর শিবচরের কুতুবপুর এলাকার হায়দার আলী বলেন, ‘পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে কমবেশি দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে মহাসড়কের রেলিং ভেঙে বাস খাদে পড়ে এত প্রাণহানির ঘটনা আগে ঘটেনি। এটি এক্সপ্রেসওয়েতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা।’ ‘বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না’
এদিকে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) সূত্রে জানা গেছে, মাদারীপুরের শিবচরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়া ইমাদ পরিবহণের বাসটির চলাচলের অনুমতি ছিল না। বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদও পেরিয়ে গেছে। চার বছর আগেও বাসটি গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় পুলিশের একজন উপ-পরিদর্শকসহ (এসআই) চারজন মারা যান। এর পর থেকে বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল।
বিআরটিএর তথ্য মতে, ভারতের অশোক লিল্যান্ড কোম্পানির বাসটি তৈরি হয়েছে ২০১৭ সালে। এর নিবন্ধন নেয়া হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। নিবন্ধনে উল্লেখ করা হয় এ বাসের যাত্রী আসন ৪০টি। এরপর প্রায় প্রতি বছরই ফিটনেস সনদ নেওয়া হয়। তবে সর্বশেষ গত ১৮ জানুয়ারি বাসটির ফিটনেস সনদের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। এটি ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে খুলনা পর্যন্ত চলাচলের জন্য অনুমতি (রুট পারমিট) নেয়া হয়েছিল।
বাসটি সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক পান্থপথ শাখা ও ইমাদ প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির যৌথ নামে কেনা। কোম্পানির মালিক হাবিবুর রহমান শেখ। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের আলিয়া মাদরাসা রোডের হারুন টাওয়ারে।
বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রুট পারমিট দেয়ার পর সড়কে বাস চলল কি না বা স্থগিত করার পর পুনরায় চলাচল করছে কি না, তা দেখার মতো বিআরটিএর লোকবল বা ব্যবস্থা নেই। পুলিশ চাইলে যেকোনো সময় ব্যবস্থা নিতে পারে। এখন পুলিশ নীরব থাকলে শাস্তি কার্যকর করা কঠিন।
আমাদের মাদারীপুর প্রতিনিধি জানান, মাদারীপুরের শিবচরে পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়ের কুতুবপুর এলাকায় যাত্রীবাহী বাস খাদে পড়ে ১৯ জন নিহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। একই সঙ্গে নিহত ব্যক্তিদের পরিবারপ্রতি ২০ হাজার টাকা এবং আহত যাত্রীদের ৫ হাজার টাকা করে আর্থিক সহযোগিতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) রহিমা খাতুন এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক পল্লব কুমার হাজরাকে প্রধান করে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটিতে জেলা পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন বিভাগের প্রতিনিধিরা থাকবেন। আগামী দুই কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটিকে দুর্ঘটনার মূল কারণ, কাদের গাফিলতিসহ বিস্তারিত অনুসন্ধান করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। রহিমা খাতুন আরও বলেন, দুর্ঘটনায় নিহত প্রত্যেকের দাফন-কাফনের জন্য তাদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা আর্থিক সহযোগিতা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা খরচের জন্য পাঁচ হাজার টাকা দেয়া হবে।