স্টাফ রিপোর্টার: পদ্মা সেতুতে রেললাইন স্থাপনে জটিলতা দেখা দিয়েছে। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প চিঠি দিয়ে বলেছে, যান চলাচলের জন্য সেতুটি খুলে দেয়ার অন্তত ছয় মাস আগে রেললাইন স্থাপনের কাজ শুরু করতে হবে। সেতু চালুর পর পাথরবিহীন রেলপথ স্থাপনের কাজ করলে ‘সার্ভে বেইস লাইন’ নিয়ন্ত্রণে জটিলতা সৃষ্টি হবে। শতভাগ সঠিকভাবে রেল অ্যালাইনমেন্ট বসানো যাবে না। তবে সেতু প্রকল্প থেকে বলা হচ্ছে, সেতুর কাজ শেষ করার আগে রেললাইন স্থাপনের অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা নদীতে দ্বিতল সেতু নির্মাণের কাজ চলছে। সেতুর উপরিভাগে (আপার ডেক) চার লেনের সড়কে চলবে যানবাহন। নিচের তলায় (লোয়ার ডেকে) চলবে ট্রেন। গত ৯ ডিসেম্বর শেষ স্প্যান স্থাপনের মাধ্যমে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে সেতুটির পুরো কাঠামো দৃশ্যমান হয়েছে। আগামী বছরের জুনে সেতুর কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, উদ্বোধনের দিন থেকেই সেতুতে গাড়ি ও ট্রেন চলবে। প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুতে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের পরিকল্পনা অনুযায়ী, সেতু উদ্বোধনের দিন মাওয়া থেকে পদ্মা সেতু হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ট্রেন চলবে। তবে এ জন্যে সেতুতে রেললাইন স্থাপনের কাজ এখনও শুরু হয়নি। কবে শুরু হবে তাও নিশ্চিত নয়। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্প থেকে বলা হয়েছে, সেতুতে রেললাইন স্থাপনে ন্যূনতম ছয় মাস প্রয়োজন। তাই সেতুতে যান চলাচল শুরুর ছয় মাস আগে থেকে রেললাইন নির্মাণের কাজ শুরু করতে হবে। কাজ শুরুর অনুমতি দিতে গত ১২ জানুয়ারি রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক গোলাম ফখরুদ্দিন এ চৌধুরী চিঠি দিয়েছেন সেতু প্রকল্পের পরিচালক মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামকে। গত বছরের আগস্টে ইন্টারফেস কমিটির সভাতেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, উপরিভাগে সড়ক (রোড ডেক) নির্মাণকাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর নকশা অনুযায়ী ৯০ শতাংশ ভার সেতুর ভিত্তির ওপর পড়বে; বা সেতুতে যেসব অংশ সংযোজন করা হয়েছে, সেসবের ওজনের ৯০ শতাংশ ভিত্তির ওপর পড়বে। ‘চীনা ব্রিজ ডিজাইন কোড’ অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ ভর আরোপিত হওয়ার পর মূল সেতুর ‘সেটেলমেন্ট মনিটর’ করা হবে। অর্থাৎ সংযোজিত অংশগুলোর ভারের কারণে সেতুর পিলারগুলো দেবে যাচ্ছে কিনা তা দেখা হবে। রেল সংযোগ প্রকল্পের চিঠিতে বলা হয়েছে, সেতুতে ‘রেল ডেক’ এবং ‘সড়ক ডেক’ স্থাপনের অগ্রগতির সঙ্গে ‘সেটেলমেন্ট মনিটরিং’য়ের কাজ শুরুর বিষয়ও জড়িত। সেতুতে রোড ডেক স্থাপনের কাজ শেষ হওয়ার পর রেল সংযোগ প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডকে (সিআরইসি) ‘সেটেলমেন্ট মনিটরিং’ শুরুর অনুমতি দিতে হবে। রেল সংযোগ প্রকল্পের চিঠিতে বলা হয়েছে, সেতুতে পাথরবিহীন রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু করতে সেতু প্রকল্প অনাপত্তিপত্র না দিলে জটিলতা হবে। তখন সেতু চালুর পর রেললাইন নির্মাণ করতে হবে। এতে সেতুতে যান চলাচলের কারণে সঠিকভাবে লাইন স্থাপন করা যাবে না। সিআরইসি’র বরাতে চিঠিতে বলা হয়েছে, সেতু চালু বা যান চলাচল শুরুর পর রেললাইন স্থাপনের কাজ করতে গেলে কংক্রিটিং করার সময় ‘রোড ট্রাফিক ব্লক’ নেয়া সম্ভব হবে না। চিঠি পেয়েছেন জানিয়ে পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, কবে রেললাইন স্থাপনের অনুমতি দেয়া যাবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। সেতু চালুর ছয় মাস আগে অনুমতি দেয়া সম্ভব হতে পারে; আবার নাও হতে পারে। আগে সেতুর কাজ শেষ করা হবে। এরপর রেললাইন স্থাপনে অনাপত্তি দেয়া হবে। ইচ্ছাকৃত কোনো বিলম্ব করা হয়নি। ভবিষ্যতেও করা হবে না। পদ্মা সেতু এবং রেল সংযোগ দুটিই সরকারের অগ্রাধিকারের প্রকল্প। কিন্তু কারিগরি কারণেই কিছু জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে। তা বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সমাধান করা হয়েছে বা হবে। পদ্মা সেতু এবং রেল সংযোগ প্রকল্পে ‘মতপার্থক্য’ এবারই প্রথম নয়। গত আগস্টে রেল সংযোগ প্রকল্পের ভায়াডাক্ট (উড়াল অংশ) নির্মাণের কাজ আটকে দেয় সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ)। মাওয়া এবং জাজিরায়, পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তেই সংযোগ সড়ক থেকে যানবাহন ওঠার পথে রেলের ভায়াডাক্টের উচ্চতা এবং প্রশস্ততা নকশার চেয়ে কম বলে অভিযোগ করে বিবিএ। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নকারী বিবিএ বলছে, মাওয়া প্রান্তে রেল সংযোগের ভায়াডাক্টের ১৪ এবং ১৫ নম্বর পিয়ারের (পিলার) মধ্যে দূরত্ব ১১ দশমিক ৫ মিটার। নকশা অনুযায়ী থাকার কথা অন্তত ১৫ মিটার। এই দুই পিয়ারের নিচ দিয়ে নির্মিত সড়ক দিয়ে গাড়ি উঠবে পদ্মা সেতুতে। কিন্তু পিয়ার দুটির ওপরের ভায়াডাক্টের উচ্চতাও কম। থাকার কথা ছিল ৫ দশমিক ৭ মিটার। রয়েছে ৪ দশমিক ৮ মিটার। এতে লরি, কাভার্ডভ্যানের মতো বড় গাড়ি আটকে যাবে। একই সমস্যা জাজিরা প্রান্তেও। বিবিএর অভিযোগ অনুযায়ী, সেখানে রেল সংযোগের ২৫(১) এবং ২৫(২) পিয়ারের মধ্যে ১৫ মিটার জায়গা থাকার কথা ছিল। রয়েছে ৯ দশমিক ৬৫ মিটার। তবে রেল বলছে, ১১ দশমিক ৫ মিটার জায়গা আছে। সেখানেও ভায়াডাক্টের উচ্চতা কম। আন্তর্জাতিক মাপ অনুযায়ী ভায়াডাক্টের মধ্যে প্রস্থে ১৫ মিটার এবং উচ্চতায় ছয় মিটার জায়গা থাকার কথা। এ বিতর্কে প্রায় ছয় মাস ধরে সেতু এলাকায় রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ আটকে রয়েছে। সম্প্রতি দুই প্রকল্পের নকশা সমন্বয় করে রেলের ভায়াডাক্টের পাইল স্থানান্তর এবং সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। রেল সংযোগ প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, এ কারণে তাদের কাজ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, রেল সংযোগের মাওয়া-ভাঙ্গা অংশের দুটি প্যাকেজের অগ্রগতি ৭৬ এবং ৪১ শতাংশ।